ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আন্দোলন ও দলীয় আইনজীবীদের আন্তর্জাতিক মহলে সঠিক প্রচারে ব্যর্থতার অভিযোগসহ নানা বিষয়ে সমালোচনা করে বিএনপি নেতাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। আজ রবিবার রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোরে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর লেখা ইংরেজি গ্রন্থ “বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ, হার স্টোরি’ -এর বাংলা সংস্করণ ‘খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ইতি প্রকাশন ৬৭০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। শাহরিয়ার সুলতান ইংরেজি গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থটির মূল্য দুই হাজার টাকা।
বক্তব্যের শুরুর দিকে বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল বলেন, এত মানুষ হতাশ, এত কিছু আছে, তারপরেও এই আন্দোলনটাকে একটা যৌক্তিক জায়গায় গেলো না কেন? এখানে অনেক ব্যাখ্যা আছে, অনেকেই নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা বলেন, বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা বলেন। অনেকে সরকারের জুলুমের কথা বলেন। সত্যি কথা। এরকম গায়েবি মামলার ইতিহাসে পৃথিবীতে কোনো দেশে আছে বলে আমি জানি না।
তিনি বলেন, কিন্তু আমি মনে করি আপনাদের আরেকটি জায়গায় বিরাট ঘাটতি আছে। এই বইটা প্রসঙ্গে আমি সেটা বলি, ন্যারেটিভে ঘাটতি। আপনাদের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা হয়, মিথ্যা প্রচারণা হয়, আপনার সেগুলো ঠিকমতো জবাব দিতে পারেন না। আপনাদের কোনো রিসার্চ সেল নাই। আপনাদের কোনো ডেডিকেটেড মানুষ নাই। আপনাদের এক্সজাম্পল দেখায়? এই বইটার অনুবাদ হতে ছয় বছর লাগলো কেন? সেটা একটা প্রশ্ন। আপনার কী মনে হয়, আওয়ামী লীগ নেত্রীর সম্পর্কে এমন একটি বই লেখা হলে অনুবাদ হতে ছয় বছর লাগত? লাগত না।
আসিফ নজরুল বলেন, তার চেয়ে ভয়াবহ জিনিসটা শোনেন, যখন বেগম জিয়ার বিচার হয়, এই বিচারের মধ্যে বিতর্কিত কিছু এলিমেন্ট আছে, বিতর্কিত বিচার ছিল, সেটি নিয়ে আমি লিখেছি, বলেছি। মিজানুর রহমান খান লিখেছেন। আপনারা লিখেছেন? বলেছেন?
তিনি বলেন, এই যে এতগুলো বছর উনি জেলে আছেন, বিএনপির কত প্রোগামে তো দেখি অনেক আইনজীবী নেতা আছেন, ঝগড়া করতে করতে একজন আরেকজনকে বহিষ্কারও করেন। ইলেকশনে জেতেন। এত আইনজীবী। বড় বড় আইনজীবী আছেন। আপনার কেউ কী থরো রিসার্চ (বিস্তারিত গবেষণা) করেছেন এই মামলাটার বিচারের মধ্যে কী কী অসংগতি ছিল? ইন্টারন্যাশনাল যে জুরিস কাউন্সিল, হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন আছে, আপনারা কি তাদের কাছে দিয়েছেন যে বিচারটা ফ্লড (ত্রুটিপূর্ণ) একটা বিচার? দেন নাই। কেনো দেন নাই? আমার নিজের মনে প্রশ্নটা বারবার আসে। আশ্চর্য কথা। এতবড় একটা সংগঠন, আপনাদের বেগম জিয়া ছাড়া আছে কী? উনি নাই আপনারা নাই।
খালেদা জিয়াকে অবিসংবাদিত নেত্রী উল্লেখ করে তিনি বলেন, উনাকে এইভাবে জেলে রাখা হয়েছে, এই যে বিএনপির আইনজীবীরা রয়েছেন, মিডিয়া সেল রয়েছে, রিসার্চ সেল আছে কিনা জানি না। এই বিচারে কী কী অসংগতি আছে, সেটা খুঁজে বের করার মতো ক্ষমতা অবশ্যই বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের আছে। অনেক আছে। আপনার করেছেন?
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ইন্টারন্যাশনাল যে ফোরামগুলো আছে, এখানকার অ্যাম্বাসি আছে, সেখানে কি আপনারা বলতে পেরেছেন? এমনি মুখে বলা তো অন্য জিনিস। রাজনীতির মঞ্চে বলা তো অন্য জিনিস। এখানে বলা তো অন্য জিনিস। সেটা আপনারা কেন পারেন না?
তিনি আরো বলেন, আমি দেখলাম বিএনপির ওয়েবসাইটে একটা ভিডিও আপলোড করেছে, যখন আওয়ামী লীগ নেত্রী ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, উনাকে আবেদ খান প্রশ্ন করেছেন, আপনার জামায়াতের সঙ্গে আন্দোলন করলেন কেন? উনি কী উত্তর দিয়েছেন জানেন?
সরাসরি বলেছেন, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে গেছি জামায়াতের সাথে। অস্বীকার করেনি কিন্তু। এবং তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। সহজ কথা। এর আগে একটা পত্রিকায় দেখেছি উনি বলেছেন, উনি শুধু আওয়ামী লীগের নেত্রী না। সকল বিরোধীদলের নেত্রী। বিরোধীদল বলতে তখন জামায়াতকে বুঝিয়েছে। নিজামীকে পাশে নিয়ে উনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন।
আপনাদের বিরুদ্ধে এই যে নিরন্তর প্রচারণা হয় বিএনপি-জামায়াত। কথায় কথায় বিএনপি-জামায়াত, বিএনপি-জামায়াত। আপনারা কোনোদিন এইগুলো ডকুমেন্টটেড করে সাথে সাথে বলতে পেরেছেন আওয়ামী লীগ-জামায়াতের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে?রআওয়ামী লীগ-জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। ওরা তো আপনাদের থেকে বেশি জামায়াতের সঙ্গে গেছে। যায় নাই? ওদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী গোলাম আযমের পা ছুঁয়ে সালাম করে নাই? একসঙ্গে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে নাই? এই ন্যারেটিভগুলো কি আপনারা শক্তভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বলতে পেরেছেন?
ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত সমান হয়ে গেছে কেনো? বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে – আপনারা কি এটার কাউন্টার ন্যারেটিভ রেডি করতে পেরেছেন? ওই ভিডিওটা পরশুদিন আপলোড হয়েছে কেনো? ১৯৯৬ সালের ভিডিওটা পরশুদিন আপলোড হয়েছে কেনো? সবই তো পাওয়া যায়। আপনাদের ওয়েবসাইটে গেলে তেমন কিছু পাওয়া যায় না কেনো? আপনারা কি চিন্তা করে দেখেছেন? এখানে দেওয়া মানে কি শুধু জনসভায় ভাষণ দেওয়া? লোক জমায়েত করা..মানুষকে সংগঠিত করা না? এটা ন্যারেটিভের যুগ। বয়ানের যুগ। বয়ানের বিরুদ্ধে শক্ত বয়ান, সত্যি বয়ান তৈরি করেছেন?
তিনি আরো বলেন, অন্যপক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, ১৯৭১ সালে বেগম জিয়া কোথায় ছিলেন? এই প্রশ্ন আপনার তুলতে পারেন না, ১৯৭১ সালে আপনি কোথায় ছিলেন? কেনো তোলেন না? আমার আচার্য লাগে কেনো তোলেন না? এত জঘন্য মিথ্যাচার। এত জঘন্য অপপ্রচার হয়, এটার উত্তর দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করেন না? বিচ্ছিন্নভাবে দেন। বিচ্ছিন্নভাবে দিয়ে শহীদ উদ্দীন এ্যানি জেলে গেছেন। এটার তো কোনো মূল্য নাই। আপনাদের রিসার্চ সেল কই? ওয়েব পেজটা কই..আপনি বলেন সরকারি গণমাধ্যম আপনার নিউজ প্রচার করে না। আপনি বিএনপি টিভি নামে একটা অনলাইন টিভি করেন। সমস্যা কীসের? নামই দেন বিএনপি টিভি। শক্তিশালীভাবে করেন… আপনাদের কি লোক কম আছে?
তিনি বলেন, আমি একটা সামান্য মানুষ। কালে-ভদ্রে আমি ফেসবুকে পোস্ট দিই। আমার এক মিলিয়ন ফলোয়ার আছে। আমি বার বার বলি, এই যুগটা প্রচারণার যুগ। শুধু দেশে না। গ্লোবালি দেখেন, প্যালেস্টাইনে হামলা চালাচ্ছে, ইসরায়েলের প্রচারণা আছে। তারা বলছে, আমরা হামলা চালাচ্ছি না, আমরা আত্মরক্ষা করছি। কন্টিনিউয়াসলি এটা বলে যায়। অ্যামেরিকা ইরাকে বোমা মারলো, আফগানিস্তানে বোমা মারলো। কন্টিনিউয়াসলি একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে গেলো যে ওখানে রাসায়নিক বোমা আছে।
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, আপনাদের ন্যারেটিড কোথায়? সত্যি ন্যারেটিভ, নিজেকে ডিফেন্স করার ন্যারেটিভ? অনেকে আছে আমি দেখি, মানে ভাব দেখলে মনে হয়, লন্ডন থেকে একটা ফোন পেয়েছে, উনি বড় নেতা হয়ে গেছেন। কিছুদিন পর উনি মন্ত্রী হয়ে যাবেন। ভাবটা হচ্ছে নিজের স্বার্থ চিন্তা।
তিনি বলেন, বেগম জিয়া কি নিজের স্বার্থের কারণে রাজনীতি করেছিলেন? আমরা তো দুর থেকে দেখেছি, উনি যখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন, উনি স্বার্থ চিন্তা করেননি। করলে তো উনি আগেই আপস করতে পারতেন। যখন ওয়ান-ইলেভেন গভর্নমেন্ট ছিল, ওই সময় প্রথম আপস করতে তো ওনার কাছেই গিয়েছিল, করেছেন?
আপনাদের কে কী সাফার করছেন? অবশ্যই আপনাদের অনেক নেতা জীবন হারিয়েছেন। আমি তাদের সম্মান করি। আমি তাদের কথা বলছি না। অন্য যারা মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছেন, আপনার ওনার সেক্রিফাইসটা চিন্তা করেন। আপনি ডিসাইড করেন, আপনি কী আন্দোলনটা করছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিজের জন্য নানা দেশের জন্য? দেশ আর মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠান জন্য। যখন এইভাবে চিন্তা করা যাবে আমি দেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করছি, তখন বেগম জিয়ার প্রতি আপনাদের সত্যিকারের রেসপেক্ট প্রতিফলিত হবে। উনি দেশের মানুষের ভোটাধিকারের আন্দোলন করেছেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, জাতীয় পাটিরর্ (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, জামায়াতের মজিবুর রহমান, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, সাম্যবাদী দলের (মার্কবাদী-লেলিনবাদী) হারুন চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের নূরুল হক নূর, জাগপার খন্দকার লুৎফুর রহমান, ইকবাল হোসেন প্রধান, এনডিপির আবু তাহের, পিপলস পার্টির বাবুল সর্দার চাখারি, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম, গণদলের এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী, ইসলামী ঐক্যজোটের মাওলানা আবদুল করীম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, বাংলাদেশ ন্যাপের শাওন সাদেকী, বিএনপির আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আজম খান, মনিরুল হক চৌধুরী, আবদুস সালাম, আফরোজা খানম রীতা, এসএম আবদুল হালিম, হাবিবুর রহমান হাবিব, অধ্যাপক শাহিদা রফিক, অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম, ইসমাইল জবিহউল্লাহ, বিজন কান্তি সরকার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, জহির উদ্দিন স্বপন, শামা ওবায়েদ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, আফরোজা আব্বাস, শিরিন সুলতানা, নিলোফার চৌধুরী মনি, এবিএম আশরাফ উদ্দিন নিজাম, অধ্যাপক আনম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক গোলাম হাফিজ কেনেডী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।