ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের সম্পদের পাহাড় গড়ায় সরকার এবং রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। দায় রয়েছে তাদের নিয়োগকারীদেরও। তেমনি ‘চোরাচালানের টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বে’ কলকাতায় খুন হওয়া এমপি আনোয়ারুল আজীমকে সংসদে যাওয়ার পথ করে দেওয়ারও দায় রয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক এসব কথা বলেছেন। শহীদ খান বলেছেন, এখন যেসব অভিযোগ উঠছে– আজিজ আহমেদ, বেনজীর আহমেদ এবং আনোয়ারুল আজীমরা পদে থাকা অবস্থায় তা তুলে না ধরায় সংবাদমাধ্যমেরও দায় রয়েছে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে আদালত বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ২০২ দলিলে ৬২১ বিঘা জমি জব্দ করেছেন। ২০২৩ সালের ৫ মার্চ মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকায় কেনা গুলশানের ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুটের চার ফ্ল্যাটও জব্দ করা হয়েছে। ফ্ল্যাটগুলোর প্রকৃত মূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি।
বেনজীর আহমেদ ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার, তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পাওয়া গেছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা বেনজীর আহমেদের বিদেশে সম্পদ রয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখতে বলেছে দুদক। বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের শতভাগ মালিকানায় থাকা সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা ইকো রিসোর্ট ও একটি শিশির বিন্দু নামের প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দ করেছেন আদালত।
দুই দফায় জব্দ করা ৬২১ বিঘা জমির ৫২১ বিঘাই বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। এর মধ্যে বেনজীর আহমেদ আইজিপি পদে থাকা অবস্থায় ২০২১ ও ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় ১১৩টি দলিলে জীশান মীর্জার নামে ২৭৬ বিঘা জমি কেনা হয় মাদারীপুরের সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায়। প্রতি শতাংশের গড় দাম মাত্র সাড়ে ১১ হাজার টাকা। যদিও প্রকৃত দাম আরও অনেক বেশি। সম্প্রতি বেনজীর আহমেদ ফেসবুক লাইভে দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী-কন্যারা ২০১৪ সাল থেকে মৎস্য ব্যবসা করছেন। যদিও এর আগে জীশান মীর্জার পেশা ছিল অজানা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত রোববার জানান, বেনজীর আহমেদের বিচারে সরকারের সমর্থন রয়েছে।
তবে এ বক্তব্যকে দায়সারা মনে করেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, বিশেষ করে বেনজীর আহমেদ তো এক দিনে এত সম্পদ করেননি। অবসরের পর তো ব্যবসা-বাণিজ্য করে করেননি। চাকরিতে থাকাবস্থায় খবর এসেছিল, বেনজীর আহমেদ সর্বোচ্চ করদাতার সম্মান পেয়েছেন। তখন ভাবছিলাম, একজন সরকারি চাকুরে কী করে সর্বোচ্চ করদাতা হন! এত সম্পদ তো তিনি লুকিয়ে করেননি। যাদের নজরদারি করার কথা ছিল, তারা করেননি। সরকার তাঁকে একের পর এক পদক দিয়েছে। সরকার কি তখন যাচাই-বাছাই করেননি? এই দায়িত্ব তো সরকার এবং সরকারি সংস্থার।
একই ভাষ্য সাবেক সচিব শহীদ খানের। তিনি বলেছেন, সরকারি চাকুরেদের প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দিতে হয়। তা নেওয়া হয়নি বলেই বেনজীর আহমেদের এত সম্পদের কথা এখন জানা যাচ্ছে। সম্পদ হিসাব না নেওয়া রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। শুধু আইজিপি নন, একজন কনস্টেবল পদের অপব্যবহার করে যদি সম্পদ অর্জন করেন এই দায় রাষ্ট্রের। শুধু সচিব নন– কেরানি; শুধু বিচারপতি নন– বেঞ্চ ক্লার্কও যদি অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন, তা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বলতার লক্ষণ।
পদে থাকাবস্থায় ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও অবসরের পর সরকারি পদস্থ চাকুরে ধরার আইনের আওতার নজিরের বিষয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, এর মানে হচ্ছে পদে থাকাবস্থায় ওই কর্মকর্তার কাছ সুবিধা নেওয়া হয়। বেনজীর আহমেদ আইজিপি পদে থাকাবস্থায় নির্বাচন নিয়ে কী বক্তব্য দিয়েছিলেন খেয়াল করুন। অবসরের পর তো আর কাউকে ভাগ-বাটোয়ারা দিতে পারেন না সরকারি কর্মকর্তারা। ফলে তখন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত ২০ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়েন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁর কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, আজিজ আহমেদ তাঁর তিন ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেন। তা করতে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। এ ছাড়া অন্যায্যভাবে সামরিক খাতে ঠিকাদারি নিশ্চিত করার জন্য তিনি তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন।
আজিজ আহমেদের ছোট ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফ দুটি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় তিনি ২০১৯ সালে কারামুক্ত হন। আজিজ আহমেদের অপর দুই ভাই হারিস আহমেদ দুটি এবং আনিস আহমেদ একটি হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। জেনারেল আজিজ সেনাপ্রধান থাকাকালে তাদের নির্বাহী আদেশে ক্ষমা করে সরকার। এর আগেই তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে দেশ ছাড়েন। জোসেফও নাম-পরিচয় পাল্টে পাসপোর্ট পান।
আজিজ আহমেদের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য, সাবেক সেনাপ্রধান অপরাধ করে থাকলে তা সেনাবাহিনী দেখবে। এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক মনে করেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের কেউ সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তাঁর কোর্ট মার্শাল হতে পারে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ঠিকাদারিতে দুর্নীতির মতো ফৌজদারি অভিযোগ থাকলে, তা প্রচলিত আইনে বিচার করা যায়। আজিজ আহমেদ তাঁর ভাইদের জন্য কী করেছেন, তা প্রকাশ্যে রয়েছে। এতে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা নেই। যাদের মাধ্যমে তাঁর ভাইদের জবাবদিহির আওতার বাইরে রেখেছেন, তাদেরও দায় রয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যে ধারায় দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে– নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া ব্যক্তি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের অংশীদার। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, আজিজ আহমেদ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেননি। যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করেছে, তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পদে থাকা অবস্থায় ব্যবস্থা নেওয়ার নজির থাকার প্রসঙ্গে ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, ক্ষমতাবানরা পদে থাকা অবস্থায় তদন্ত করা দুরূহ। আইজিপি বা সেনাপ্রধানের তো প্রচুর ক্ষমতা রয়েছে তদন্তকারীদের হেনস্তা করার। অন্যান্য দেশেও দেখা যায়, তদন্ত এবং সাজা হয় পদ থেকে চলে যাওয়ার পর।
সরকারি চাকরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের দায় ‘নিয়োগ প্রক্রিয়া’কে দিয়েছেন শাহ্দীন মালিক। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি চাইলেই যে কাউকে যে কোনো পদে বসাতে পারেন না। কংগ্রেসে শুনানি হয়। বাংলাদেশে তা হয় না। বরং গোপনে নিয়োগ, পদোন্নতি হয়। ধরুন, সেনাপ্রধান নিয়োগে যদি পদটির যোগ্য কয়েকজনকে বাছাই করে সাবেক কয়েকজন সেনাপ্রধান নিয়ে শুনানি করে নিয়োগ করা হতো, তাহলে যোগ্যতম প্রার্থী পদে আসতেন।
কলকাতায় খুন হওয়া এমপি আজীমের বিষয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, একজন সংসদ সদস্য চুরি করে ভারতে গেছেন। মানে তিনি সংসদ সচিবালয়কে না জানিয়ে বিদেশে গেছেন। এখন তো দেখা যাচ্ছে, তিনি অবৈধ কাজ করতে যাচ্ছেন বলেই অবহিত করে যাননি। এটা আসলে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার নজির। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব দলেই এমন লোক আছে।
আবুল আলম শহীদ খান বলেছেন, বলা হচ্ছে– ‘আনোয়ারুল আজীম কী ছিলেন, তার চেয়ে বড় কথা তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।’ এটা কোনো কথা হতে পারে না। একজন চোরাকারবারি কীভাবে এমপি হয়ে যান! তাঁকে যারা বাছাই করেছেন, এই দায় তাদেরও।