ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ১১ বছরেও কোনো হদিস মেলেনি কুমিল্লা-১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও লাকশাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম হিরুর। এ পর্যন্ত ৫৫ বার মামলার তদন্ত পিছিয়েছে। প্রথমে পুলিশ এরপর অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), সর্বশেষ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভিস্টিগেশন (পিবিআই) আলোচিত এই মামলার তদন্ত করছে। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের তারিখ আসলেই তদন্তকারী সংস্থা আদালত থেকে সময় প্রার্থনা করেন। ফলে সাবেক সংসদ সদস্য হিরু গুমের মামলার বিচারিক কার্যক্রম এগোচ্ছে না।
হিরু লাকসাম উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি। চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাত ৯টার দিকে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার হরিশ্চর সড়ক থেকে র্যাব পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এসময় তার সঙ্গে তার ভাই লাকশাম পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতির ছেলে হুমায়ুন কবীর পারভেজও নিখোঁজ হন।
সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান ইসলাম বলেন, নিখোঁজের পরপরই আমরা খবর পাই। ঘটনার পরপরই থানা, র্যাব অফিসসহ অনেকেরই দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। দিন-মাস-বছর পেরিয়েছে। এক যুগ হয়ে গেছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না। আব্বু বেঁচে আছেন; কী মরে গেছেন; কিছুই জানি না। আব্বুও তো একজন সাবেক সংসদ সদস্য। ভারতে নিহত আওয়ামী লীগের এমপির বিষয়টি নিয়ে সরকার বা কর্তৃপক্ষ যতটা মাথা ঘামাচ্ছে, আব্বুর বিষয়টি নিয়ে কোনো মাথা ব্যথাই নেই।
এমপি সাইফুল ইসলাম হিরুর নিখোঁজ হওয়া এবং একই দিনে তার সঙ্গে আটক মোট ১১ জনের মধ্যে ৯ জনকে লাকশাম থানায় হস্তান্তরসহ নানান বিষয়ে কথা বলেন তার ছেলে রাফসান ইসলাম।
রাফসান ইসলাম বলেন, ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টা। তখন বিএনপি জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। লাকসাম শহরে আমাদের একটি ময়দার কারখানা আছে। কারখানার কাজ শেষে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন আব্বু। তিনি এবং তার দুই সহকর্মী অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আব্বু বের হওয়ার একটু পরই কারখানায় অভিযান চালায় র্যাব। এসময় লাকসাম শহরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। অভিযানকালে কারখানায় আমার দুই চাচা ও দুজন ব্যাংক কর্মকর্তাও বসে কথা বলছিলেন। কারখানায় অভিযানের একটু পরই আমরা জানতে পারি। আম্মু, আমার দুই বোন এবং আমি ঢাকার বাসায় ছিলাম।’
রাফসান বলেন, ‘আব্বুর সঙ্গে আটক হয়ে পরে মুক্তি পাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের জানায়, রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের হরিশ্চর সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে আব্বুকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি (ঢাকা মেট্রো-ছ-৭১-১২৬৫) আটক করে। পরে র্যাবের ভ্যানে করে তাদের একটি খোলা মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। কারখানা থেকে যাদের আটক করা হয়েছিল তাদেরও র্যাবের ভ্যানে করে ওই মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। আব্বুর সঙ্গে থাকা অন্য দুজনকেও ওই র্যাবের ভ্যানে ওঠানো হয়। সেখানে আরো সাতজন ছিল।’
‘ওই মাঠে বসেই আটক ১১ জনের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় র্যাবের এক কর্মকর্তার মোবাইলে একটি ফোন আসে। তিনি কথা বলার কিছুক্ষণ পরেই ৯ জনের র্যাবের গাড়ি থেকে হুমায়ুন কবীর পারভেজকে নামিয়ে আব্বুকে যে ভ্যানে রাখা হয়েছিল সেই ভ্যানে তোলা হয়। ৮ জনের ভ্যানটি নেওয়া হয় লাকসাম থানায়। থানায় গিয়ে আব্বু এবং পারভেজ ভাইয়াকে না দেখে আমাদের পরিবারের সদস্যরা এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে জানতে চায়। কিন্তু পুলিশ কোনো জবাব দেয়নি।’ যোগ করেন রাফসান।
‘পরে আমরা হরিশ্চর পুলিশ ফাঁড়িতে যোগাযোগ করি। তারাও কোনো তথ্য দিতে পারলো না। এরপর থেকে দিন মাস বছর পেরিয়ে যুগ পেরিয়ে চললো; আব্বু এবং হুমায়ুর কবীর ভাইয়ের আর কোনো খবর আমরা পেলাম না।”
তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তুলে নেওয়া হয়, শনিবার পর্যন্ত কোনো খবর না পেয়ে রোববারে আমরা আদালতে যাই। আদালতে বাকিদের হাজির করা হলেও আব্বু এবং তার সঙ্গে থাকা হুমায়ুন ভাইকে হাজির করা হয়নি। এরপরই লাকসাম থানায় গেলাম মামলা করার জন্য। পুলিশ মামলা নিলো না। থানা-পুলিশ আমাদের কাছেই ঘটনার প্রমাণ দাবি করলো। উপায়ান্তর না পেয়ে “বাবা হারিয়ে গেছে” উল্লেখ করে লাকসাম থানায় সাধারণ ডাযেরি (জিডি) করি।
পরে আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১-এর কার্যালয়ে যাই। তখন র্যাব-১১ এর সিইও ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সেভেন মার্ডারে অভিযুক্ত তারেক সাঈদ। তার সঙ্গে কথা বলি; কিন্তু তারেক সাঈদ বিষয়টিতে কান দিলেন না। ২৭ নভেম্বর র্যাব অভিযান চালালেও আমার আব্বুকে আটক করেনি বলে জানান তারেক সাঈদ। এর পর কতশত মানববন্ধন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনে চিঠি, সংবাদ সম্মেলন, কত কী-ই না করেছি। কিন্তু আব্বুকে পাইনি। এখনো দিন-রাত খুঁজি। জানি না আব্বু আর কখনো আমাদের কাছে ফিরবেন কিনা।
রাফসান বলেন, পরে অবশ্য আদালতে আমার একটি মামলা করেছিলাম। মামলার বাদী ছিলেন আমার চাচা রঙ্গু মিয়া। মামলা করার তিন বছর পর তিনিও মারা গেছেন। আদালত প্রথমে পুলিশকে, পরে সিআইডিকে এবং সর্বশেষ পিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করাচ্ছে মামলাটির। কিন্তু তদন্ত সংস্থা এ পর্যন্ত ৫৫ বার সময় নিয়েছে। বিচার প্রত্যাশা করি, কিন্তু কোনো আলো তো দেখছি না।
ওই দিন আব্বুর সঙ্গে আটকের পর যাদের লাকসাম থানায় হস্তান্তর করেছিল; থানায় লিখিতভাবে ওই ৮ জনকে নিজের ব্যাচ নম্বরসহ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন র্যাব-১১-এর ডিএডি শাহজাহান আলী। কিন্তু পরে র্যাব-১১-এর সিইও তারেক সাঈদ বলেছিলেন, আব্বুকে র্যাব আটক করেনি। তারেক সাঈদ এখন আলোচিত সেভেন মার্ডারের মামলায় কারাগারে আছেন, তাকে এবং এই ডিএডি শাহজাহান আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই আব্বুর ব্যাপারে খোঁজ পাওয়া যাবে বলে আমার পরিবার এবং আটকের পর ফিরে আসা সবাই মনে করছেন বলে উল্লেখ করেন রাফসান ইসলাম।
এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু নিখোঁজের সময় রাফসানুল ইসলামের বয়স ছিল ১৭ বছর। বর্তমানে পড়াশোনা শেষ করে দেখছেন বাবার ব্যবসা। বড় দুই বোন মাশরুফা এবং তাসনুভা। দুজনই বিবাহিত। এর মধ্যে একজন ব্যাংকার, আরেকজন ফ্যাশন ডিজাইনার। বর্তমানে মা ফরিদা ইসলাম হাসিকে নিয়ে গুলশানের বাসায় থাকেন রাফসান।
এমপি হিরু নিখোঁজের পর থেকে তার সন্ধান চেয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অফিসে গিয়েছেন স্ত্রী ফরিদা ইসলাম হাসি। শোকে পাথর ফরিদা ইসলাম হাসি বাসায় একেবারে চুপচাপ দিন কাটাচ্ছেন। একদিন ঠিকই স্বামী বাড়িতে ফিরবেন সেই আশায় পথপানে চেয়ে চেয়ে দিন কাটছে তার।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভিস্টিগেশন পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কান্তি মজুমদার বলেন, পিবিআইয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিছুটা বিলম্ব হলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারব বলে আশা করছি।
এদিকে পিবিআইয়ের কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, ছয় মাস আগেই পিবিআই তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে। রিপোর্ট আদালতে রয়েছে। সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান ইসলামের তদন্ত সংস্থার রিপোর্ট না দেওয়ার দাবিটি সঠিক নয় উল্লেখ করেন পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা হয়তো মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানেনই না।
তবে রাফসান ইসলামের দাবি, পিবিআই এ পর্যন্ত ৫৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নিয়েছে আদালত থেকে। এ তথ্যই সঠিক বলে দাবি করেন রাফসান ইসলাম।
বস্তুত, দীর্ঘদিন ধরে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন থাকায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে কিনা সে বিষয়ে সঠিক তথ্য কোনো পক্ষের হাতেই নেই বলে অনুমান করা হচ্ছে।