DMCA.com Protection Status
title="৭

ফেরারি জীবনের অনিশ্চয়তায় বিএনপি অগনিত নেতাকর্মী

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বছরের পর বছর ফেরারি জীবন কাটছে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর। তাদের মধ্যে কেউ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে, কেউ সাজাপ্রাপ্ত হয়ে, আবার কেউ আইনি জটিলতা এড়াতে ঘরছাড়া। পরিবার-পরিজন ছাড়া নিঃসঙ্গ জীবনে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন, কেউ বলতে পারছে না। একের পর এক মামলায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা।

অনেক নেতাকর্মী আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেও আর্থিক সংকটে বেশির ভাগই তা পারছেন না। দলীয় সহায়তাও তেমন পাচ্ছেন না তারা। ফলে খুব শিগগির তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির দাবি, ২০০৯ সালের পর থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে তাদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯৩৪ মামলায় ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর বাইরে গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে সারাদেশে ১ হাজার ৬৪৫ মামলায় প্রায় ৭০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে মামলার হাজিরা দিতে আদালতে দৌড়াতে দৌড়াতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন বলে দলটির নেতাদের দাবি।  

বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রায় সব নেতাকর্মীরই একই অবস্থা। মামলার ভারে নুয়ে পড়ছেন তারা। খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। মামলার খরচ জোগানোয় ব্যর্থ হয়ে কেউ কেউ রয়ে গেছেন ফেরারি জীবনে। দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার একই অবস্থা। মামলা জটিলতায় দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে প্রবাসে। আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজন ছাড়া মানবেতর জীবন কাটছে তাদের।   

এর মধ্যে অন্যতম ভুক্তভোগী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রী ৯ বছরের বেশি সময় ভারতে আটকে রয়েছেন।

২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এর পর দীর্ঘ ৬২ দিন গুম থাকার পর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাওয়া যায়। তখন থেকে তিনি সেখানেই আছেন। তিনি কবে দেশে ফিরতে পারবেন, কেউ বলতে পারছেন না।

সালাহউদ্দিনের স্বজনরা জানান, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় তিনি শিলংয়ের বাইরে কোথাও যেতে পারেননি। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সেখানে তাঁর কিডনি ও ঘাড়ের দুটি অপারেশন হয়। তারও আগে বাংলাদেশে তাঁর হার্টে তিনটি রিং বাসানো হয়। এছাড়া ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে তিনি আক্রান্ত। এমন অবস্থায় তার নিবিড় পরিচর্যা দরকার। কিন্তু আইনি জটিলতায় বারবার আটকে যাচ্ছে তার দেশে ফেরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও রয়েছেন প্রবাসে। মামলা জটিলতায় তাকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। টুকু বলেন, পাকিস্তান আমলের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শুরু দিয়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি নিজে সম্পৃক্ত ছিলেন। অথচ আজ তাঁকে মিথ্যা মামলায়, অন্যায় রায়ে যাযাবরের মতো বিদেশে অবস্থান করতে হচ্ছে। জীবনের শেষলগ্নে এখন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর কথা তাঁর। অথচ আজ তাঁকে একাকী জীবন কাটাতে হচ্ছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন (কায়কোবাদ), গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নিয়েছেন।

বেশির ভাগ মামলায় বাদী পুলিশ
বিএনপি নেতারা বলছেন, নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বেশির ভাগ মামলায় বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কাজে বাধা ও হামলা, যানবাহন ভাঙচুর, আগুন দেওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব মামলার বাদী পুলিশ। এসব সাজাপ্রাপ্ত নেতাকর্মীর অনেকে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে গেছেন। তাদের অনেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তবে সাজাপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশ এখনও আত্মগোপনে রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ নেতাকর্মী আর্থিক অসচ্ছলতায় বিপাকে পড়েছেন। একাধিক মামলা থাকায় নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত লাখ লাখ টাকা ব্যয় করার মতো সামর্থ্য অনেকেরই নেই।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের আহ্বায়ক খন্দকার এনামুল হক এনাম গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচির অনেক আগে থেকেই ঘর ছাড়েন গ্রেপ্তার আতঙ্কে। মহাসমাবেশ পণ্ডের পর টানা আড়াই মাসের আন্দোলনের পরও আর ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর। নির্বাচনের আগে পুরোনো দুই মামলায় ছয় বছরের সাজাও ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

এনামের স্ত্রী নাজনীন আক্তার জানান, দীর্ঘদিন পর মেয়েকে দেখতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে ৯ বছরের মেয়ে খন্দকার মারিয়াম জান্নাত তানুশকা বাবাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাবাকে বলে– এখন থেকে তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। মেয়ের এমন আকুতিতে উপস্থিত সবার চোখে পানি চলে আসে। এনামের  দুই চোখও ভিজে যায়।

এনাম জানান, তাঁর বিরুদ্ধে ৩২৬ মামলার ৫৩টিতে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে, সাজা হয়েছে তিনটিতে। নতুন করে জামিন নিতে হবে ৭৭ মামলায়। এসব মামলায় তাঁর ২ লাখের বেশি টাকা খরচ হবে। তবে সেই সাধ্য না থাকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাঁর পুরো দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন আইনজীবীরা বললেই তিনি আত্মসমর্পণ করবেন।

জানা গেছে, নির্বাচনের পর পুলিশের ধরপাকড় কমে আসায় সাজা হওয়া নেতাকর্মীর অনেকে আদালতে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি জহির উদ্দিন তুহিন। তাঁর স্ত্রী শিউলি আক্তার জানান, দীর্ঘ এক বছর ফেরারি জীবন শেষে এখন তিনি কারাগারে। তুহিন দীর্ঘ দিন ধরেই অসুস্থ। তাঁর হার্টে রিং পরানো। এর মধ্যে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় আরও অনেক অসুখ বাসা বেঁধেছে শরীরে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!