DMCA.com Protection Status
title="৭

৪ জুনের পর ভারতের রাজনীতি আগের মতো থাকবে না

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারতের ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল, বালাকোটের মতো দেশব্যাপী উন্মাদনা নেই, ২০১৯ সালের নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তার করেছিল যে উন্মাদনা।

তাছাড়া ‘৫৬-ইঞ্চি হ্যালো’ও এবার নেই, যা লক্ষ লক্ষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবককে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং নরেন্দ্র মোদীকে মধ্যবিত্তের নায়ক বানিয়েছিল (মোদির বক্ষ ‘৫৬ ইঞ্চি’ যা উদ্দীপনার প্রতীক, যা বলে তরুণদের উত্তেজিত করেছিল বিজেপি)।

সেই ঢেউ সমগ্র হিন্দি বেল্টকে প্রবাহিত করেছিল এবং পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে পৌঁছেছিল। সে কারণে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, দিল্লি ও হরিয়ানার সমস্ত আসন দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। কর্ণাটকে ২৮টির মধ্যে ২৫টি, মধ্যপ্রদেশের ২৯টির মধ্যে ২৮টি, ছত্তিশগড়ে ১১টির মধ্যে ৯টি ও ঝাড়খন্ডে ১৪টি আসনের মধ্যে ১১টি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও দলটি ১৮টি আসন পেতে সক্ষম হয়েছিল।

মনে রাখবেন, মোদি কখনও তরঙ্গহীন, স্বাভাবিক নির্বাচনে জয়ী হননি। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইনের বিধি এবং কাচাথিভু দ্বীপের মতো বিষয়গুলি এই সময় উত্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু একটি দেশপ্রেমমূলক অনুভূতি ছড়াতে ব্যর্থ হয়েছিল।

ক্ষমতাসীন দলের বড় দুইজন নেতা শুধু বক্তৃতাবাজি করছেন যা লক্ষ লক্ষ বেকারের জন্য কাজ করেনি বলে মনে হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যখনই বিরোধী নেতারা চাকরির কথা বলেছেন, তাদের সমাবেশে জনতা বন্য করতালি দিয়ে সাড়া দিয়েছে।

মোদির বক্তৃতায় দ্রব্যমূল্য, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলির অনুপস্থিতি, যেখানে দেশের ২০ থেকে ২৪ বছরের যুবকরা (আনুমানিক ৪৫ দশমিক ৪০ শতাংশ) বেকার। তারা কি সবাই পাকোড়া বিক্রি করবে? কিন্তু সবাই পাকোড়া বিক্রি করতে পারে না যে তা মোদি হয়হ ভাবেন নাই।

১৮তম সাধারণ নির্বাচনে আরেকটি দিক হল নির্বাচনি বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নীরবতা এবং ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ফল হেরফের করার আশঙ্কা। ৪ জুনের ফলাফলই বলে দেবে ইভিএম কেমন আচরণ করেছে।

ক্ষমতাসীন দলটি প্রচুর পরিমাণে বিধি লঙ্ঘন করছে এবং শেষ পর্যায়ে প্রচারাভিযানে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, যা নিয়ে পর্যাপ্ত খবর আসছে গণমাধ্যমে।

এবার ক্ষমতাসীন দল অযোধ্যাকে প্রধান প্রচারণার বিষয় হিসেবে নিয়েছে। মোদি নিজেই পবিত্র অনুষ্ঠানের প্রধান পুরোহিত হিসাবে অভিনয় করেছেন, যাতে পুরো সরকারি যন্ত্রপাতি সচল থেকেছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমানগুলি মন্দিরে ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করেছে। মিডিয়া এটাকে একটা বড় ঘটনা বানিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা অযোধ্যা-বার্তা দেশের প্রতিটি গ্রামে নিয়ে গিয়েছে—দক্ষিণের মধ্যস্থল থেকে উত্তর-পূর্ব পর্যন্ত। তবু অযোধ্যা বা রাম মন্দির ভোটারদের কাছে নির্বাচনী ইস্যু হিসেবে অনুরণিত হয়নি বলে মনে হয়েছে।

মোদিবিরোধীদের প্রাথমিকভাবে বিশৃঙ্খলা মনে হলেও তাদের প্রচারণা যত এগিয়েছে, বিরোধী নেতারা জনতার মধ্যে একটি নতুন সমন্বয় খুঁজে পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন। এটি একটি বাস্তব পরিবর্তন নির্দেশ করে কিনা তা ফলাফল দেখাবে।

প্রথম দফা ভোটের পর বিজেপিনেতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে না।

তারা এর সমাধান করতে চেয়েছেন কিভাবে?

একটি ঘৃণামূলক প্রচারণা এবং কঠোর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে।

বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির নির্বাচনী মিত্র এক-নেতার দল যার। তেলেগু দেশম পার্টির কথাই ধরুন, যেখানে এন চন্দ্রবাবু নাইডুর ছেলে নেতৃত্বের লাইনে রয়েছেন। নাইডু নিজেই দলটির প্রতিষ্ঠাতা এনটিআরের জামাতা।

কয়েক দশক ধরে বিজেপি পাঞ্জাবের বাদল পরিবারের সাথে, উত্তর প্রদেশ ও বিহারে একাধিক পরিবার-নিয়ন্ত্রিত এক-নেতার ক্রাচের সাথে জোটবদ্ধ ছিল। মোদি যখন অভিষেক ব্যানার্জিকে রাজবংশ বলে ব্যঙ্গ করেন, তখন তা রাজ্যটির বিজেপিনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে আঘাত করে যার বাবা শিসির অধিকারী মনমোহন সিংয়ের অধীনে মন্ত্রী ছিলেন। অভিষেক-শুভেন্দু বিজেপি করলেও মোদির মতো নেতার প্রতি তাদের ক্ষোভ জন্মেছে।

বিজেপি সংখ্যালঘুদের আঘাত করে মিত্রদের মধ্য থেকেও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। মুসলমানদের সম্পর্কে তার মন্তব্যের জন্য যথেষ্ট তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

চূড়ান্ত ফলাফল যাই হোক, ৪ জুনের পর ভারতের রাজনীতি আর আগের মতো হবে না। মোদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নতুন কৌশল এবং একটি সংশোধিত নীতিকাঠামো অনুসন্ধান করতে হবে। যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন তাদের সকলের ক্ষেত্রে এটি হয়েছে।

মোদির ক্ষেত্রে জীর্ণ-শীর্ণ কল্যাণমূলক পরিকল্পনা, ভাঙ্গা প্রতিশ্রুতি আগামী দিনের শাসনকে তাড়া করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই ঘৃণা ছড়ানো, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্ক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও জেলে দেওয়ার জন্য নিন্দিত এবং চাপের মধ্যে আছেন।

একদলীয়, এক-নেতা শাসনের জন্য মোদী প্রকল্পের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল দেশের অন্তর্নির্মিত বৈচিত্র্য। এর আঞ্চলিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও উচ্চাভিলাষী পরিচয়গুলি মোদির একাকার ব্যবস্থার প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আঞ্চলিক ভাষার উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ায় দক্ষিণে তীব্র প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন মোদি সাহেব। কয়েক দশক ধরে বিন্ধ্যের দক্ষিণের রাজ্যগুলি উচ্চতর মানব উন্নয়ন সূচকগুলির সাথে একটি ভাল অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা রেকর্ড করেছে। দক্ষিণের রাজ্যগুলিসহ উন্নত রাজ্যগুলির সাথে পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলির রাজস্বে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। দক্ষিণের রাজ্যগুলি কেন্দ্রের চাপানো অন্যায্য কর বিষয়ে অভিযোগ করেছে।

মোদির রাজনৈতিক ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণের ফলে বর্তমান ফেডারেল ব্যবস্থা ব্যাহত হলে এ ধরনের সুপ্ত অনুভূতি রাজনৈতিক মাত্রা অর্জন করতে বাধ্য।

আর যারা বিরোধী দলে আছে, ক্ষমতায় গেলে তাদের জন্য একটি বিশাল কাজ অপেক্ষা করছে। কেন্দ্রে জোট গঠন করা বড় চ্যালেঞ্জ। যখন এটি ঘটবে, নতুন সরকারের প্রথম কাজ হবে বছরের পর বছর ধরে নির্মিত কর্তৃত্ববাদী কাঠামো ভেঙে ফেলা। এর মধ্যে রয়েছে মাকড়ের জাল পরিষ্কার করা, যার মধ্যে রয়েছে ব্যাপক জাফরানিকরণ (স্যাফ্রোনাইজেশন বা জাফ্রোনাইজেশন ভারতের একটি নীতিপদ্ধতি যা হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়)।

(দ্য ওয়্যার ডট ইন থেকে অনুবাদ)

(পি. রমন ভারতের একজন প্রবীণ সাংবাদিক)

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!