ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃটেলিগ্রামে অপরাধীদের কাছে বাংলাদেশের নাগরিকদের গোপন ও সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে পুলিশের জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তারা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) ডাটাবেজে (তথ্যভান্ডার) নিজেদের আইডি ব্যবহার করে প্রবেশ করে ওই গোপন তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে অর্থের বিনিময়ে তা অপরাধীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও এনটিএমসির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ বাকের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, বিক্রি করা ওইসব তথ্যের মধ্যে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়ের বিস্তারিত, মোবইল ফোনের কল রেকর্ড এবং অন্যান্য অতি সংবেদনশীল তথ্য রয়েছে । চিঠিটে ২৮ এপ্রিলে দেওয়া হয়। এক সাক্ষাৎকারে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ বাকের।
অনলাইন দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বাকের বলেছেন, এই ব্যাপারে বিভাগীয় তদন্ত চলছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশের ক্ষতিগ্রস্ত সংস্থাকে ওই ‘দুই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার’ নির্দেশ দিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব বরাবর বাংলায় লেখা ওই চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা নাগরিকদের ‘খুবই সংবেদনশীল তথ্য’ সংগ্রহ করেছেন এবং অর্থের বিনিময়ে সেগুলো টেলিগ্রামে বিক্রি করে দিয়েছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, তদন্তকারীরা এনটিএমসির লগইন ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন ওই দুই কর্মকর্তা কতবার তথ্যভান্ডারে প্রবেশ করেছেন। তারপরই তাদের আটক করা হয়েছে।
চিঠিতে ওই দুই কর্মকর্তার পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়েছে। এদের মধ্যে একজন পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটে (এটিইউ) এসপি হিসেবে কর্মরত। অন্যজন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৬ এ সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র শত শত মানুষকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে প্যারা মিলিটারি সংস্থা র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এদিকে, দেশের আইনি ব্যবস্থার অধীনে ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে না পারায় এই প্রতিবেদনে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
এনটিএমসি হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটি সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা, পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য সরকারি সংস্থাসমূহকে যোগাযোগ সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তার কাজ করে থাকে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ফ্রিডম হাউসের মতো সংস্থাগুলি বাকস্বাধীনতা ও গোপনীয়তায় সংস্থাটির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষার অভাবের জন্য এনটিএমসির সমালোচনা করেছে। কয়েক বছর ধরে সংস্থাটি সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দেওয়া দেশ ইসরায়েলের কোম্পানি এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিনছে। বিরোধী দলের সদস্য, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের সদস্য এবং অধিকার কর্মীদের উপর ব্যাপকভাবে নজরদারি চালাতেই এসব যন্ত্রপাতি কেনা।
নিজেদের কাজের অংশ হিসেবে এনটিএমসি ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স প্ল্যাটফর্ম বা এনআইপি নামের একটি ওয়েব পোর্টাল চালায়। এটি সরকারের অভ্যন্তরীণ ওয়েব পোর্টাল, এটিতে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়ের বিস্তারিত, মোবাইল ফোনের নিবন্ধন, কল রেকর্ডের তথ্য, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্যসহ নাগরিকদের অন্যান্য গোপন তথ্য থাকে। এনটিএমসি এই পোর্টালে প্রবেশের জন্য্ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব ইউজার অ্যাকাউন্ট দিয়েছে।
এদিকে, এনটিএমসির নিজস্ব তদন্তে বলা হয়েছে, পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তা অন্যদের তুলনায় ঘন ঘন এনআইপি পোর্টালটি ব্যবহার করেছেন এবং তাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয় এমন তথ্যে প্রবেশ করেছেন এবং সেগুলো সংগ্রহ করেছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রবেশ এবং অতি সংবেদনশীল তথ্য বেআইনিভাবে হস্তান্তরের ঘটনায় যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিত। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যথাযত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমরা অনুরোধও জানানো হয় চিঠিতে।
ব্রিগেডিয়ার বাকের বলেন, টেলিগ্রামে অনেকগুলো চ্যানেল ছিল, তার মধ্যে একটির নাম ছিল ‘বিডি সাইবার গ্যাং’। যদিও বাংলা আউটলুক টেলিগ্রামে নির্দিষ্ট ওই চ্যানেলটি শনাক্ত করতে পারেনি।
বাকের আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে ওই দুই কর্মকর্তা তথ্যগুলো অন্তত একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের অ্যাডমিনের কাছে পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে তিনিই সেগুলো বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন। তদন্তের বিষয়টি ওই কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
এদিকে, চিঠিতে আরও বলা হয়, নাগরিকদের তথ্য বিক্রির এই ঘটনা চলমান থাকায় এবং জড়িত কর্মকর্তাদের শনাক্ত ও উপযুক্ত পদক্ষেপের আগ পর্যন্ত এনআইপিতে এটিইউ এবং র্যাব-৬’র সব ইউজারের প্রবেশ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার বাকেরও এই স্থগিতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, যদি কোনো এজেন্টের তদন্তের উদ্দেশ্যে কোনো তথ্যের দরকার হয়, তবে তারা তা পুলিশ এবং র্যাবের সদর দপ্তরের মাধ্যমে পেতে পারে।
এসব ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং এটিইউর মুখপাত্রের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেননি। তবে ‘অপারেশন অফিসার’ পরিচয়ে র্যাব-৬ এর এক ব্যক্তি বলেছেন, এই ব্যাপারে প্যারা মিলিটারি এই সংস্থার কোনো মন্তব্য নেই।
গত বছর এক নিরাপত্তা গবেষক দেখিয়েছেন যে, এনটিএমসি একটি অসুরক্ষিত সার্ভারে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করছে। ওই সময় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ফাঁস করা ওই তথ্যে নাগরিকদের প্রকৃত নাম, মোবাইল নম্বর, ই-মেইলের ঠিকানা, অবস্থান এবং তাদের পরীক্ষার ফলাফলও ছিল। একইভাবে গত বছর বাংলাদেশের সরকারি আরেক সংস্থা রেজিস্টার জেনারেলের (জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন) কার্যালয়ও নাগরিকদের সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস করে। ওই সময় প্রযুক্তি ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চে এই নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। উভয় সংস্থার ক্ষেত্রে তথ্য ফাঁসের ঘটনাটি বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটিতে কাজ করা গবেষক ভিক্টর মারকোপাওলোসের কাছে ধরা পড়ে।
যদিও নাগরিকদের তথ্য প্রকাশের সে ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে এবারের ঘটনায় এটিইউ এবং র্যাব-৬ এর এজেন্টদের জড়িত থাকায় বিষয়টি সম্ভবত আরও গুরুতর। কারণ ওই দুই কর্মকর্তা গোপন তথ্যভান্ডারে থাকা নিজেদের প্রবেশাধিকারের সুযোগ নিয়ে আর্থিক লাভের জন্য ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে বিক্রি করেছেন।