DMCA.com Protection Status
title="৭

পুলিশ সদস্যদের হাতে প্রশিক্ষণ–কাউন্সেলিং ছাড়াই প্রাণঘাতী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে সহকর্মী কনস্টেবল মনিরুল হককে গুলি করে হত্যা করেন এক পুলিশ সদস্য। ওই কনস্টেবল কাওছার স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করেন সহকর্মীকে। গুলি করে তিনি তার দেহ ঝাঁজরা করে দিয়েছেন। সম্প্রতি ব্রাজিল থেকে আনা এসএমটি সাব মেশিনগান দিয়ে তিনি ৩৮ রাউন্ড গুলি চালান। এতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান মনিরুল।

পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, দায়িত্ব ভাগাভাগি নিয়ে কথা–কাটাকাটি হয় তাদের। এর একপর্যায়ে কনস্টেবল কাওছার উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাৎক্ষণিক ৩৮ রাউন্ড গুলি করে মনিরুলের দেহ ঝাঁজরা করে দেন।

এখন প্রশ্ন উঠছে, এসএমটি ৪০–এর মতো আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার অনুমতি আছে এমন একজন পুলিশ সদস্য দায়িত্বরত অবস্থায় এভাবে উত্তেজিত হয়ে যাওয়াটা কি স্বাভাবিক? এমন অস্ত্র ব্যবহারে তাঁর প্রশিক্ষণ ছিল কিনা। অথবা চাপ সামলানোর মতো মানসিক দৃঢ়তা তৈরির জন্য তাঁকে কখনো কাউন্সেলিং করা হয়েছিল না কিনা।

এ বিষয়ে পুলিশেরই একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ওই কনস্টেবল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা আক্রমণকারী পুলিশ সদস্যের ব্যাপারে যতটুকু জেনেছি, তিনি পাঁচ–ছয় দিন থেকে খুব চুপচাপ ছিলেন। তার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলছিলেন না। তাঁর ব্যাচমেটদের সঙ্গে কথা বলে এসব জেনেছি।’ গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওসি) একই কথা বলেছিলেন।

এদিকে রোববার ( ৯ জুন) কাওছারের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, চাকরিরত অবস্থায় প্রায় ১৪ বছর ধরে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন কাওছার। তিনি সরকারিভাবে হাসপাতালে গিয়ে মানসিক রোগের চিকিৎসাও নিয়েছেন। সেই কাগজপত্র তাঁর কাছেই ছিল।

এসএমটি ৪০–এর মতো আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারে কনস্টেবল কাওছারের প্রশিক্ষণ ছিল কিনা সে ব্যাপারে পুলিশের কেউ কোনো কথা বলেননি। তবে মানসিক কাউন্সেলিংয়ের বিষয়ে মুখ খুলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) ড. খ. মহিদ উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি বলেছেন, ‘পুলিশ সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে এ রকম কোনো কাউন্সেলিং করা হয় না। তবে মাঝেমধ্যে তাঁদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বসে এসব বিষয়ে আলোচনা করেন।’

এ বিষয়ে পুলিশের সদর দপ্তরের প্রশিক্ষণ শাখার পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘অস্ত্রের প্রশিক্ষণ তো প্রতিবছরই দেওয়া হয়। তবে সেটা নিয়মিত প্রশিক্ষণ। এর বাইরে ইউনিট ধরে বা অস্ত্র ধরে ধরে সেভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ খুব বেশি নেই।’

কিন্তু ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলোচনা আর নিয়মমাফিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ধরিয়ে কূটনৈতিক এলাকায় পাঠানো ঝুঁকিপূর্ণ কিনা সে প্রশ্নের জবাব কারও কাছে পাওয়া যায়নি।

পুলিশ বাহিনী যে বিধানে চলে, সেই পিআরবির ৭৯৭ (গ) (২) অনুযায়ী, প্রতিবছর ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী বছরের ৩১ মার্চ সময়কে ফায়ারিং বছর হিসেবে গণনা করা হয়। এ সময় পিস্তল, রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, শটগানের ফায়ারিং অনুশীলন করানো হয়। তা ছাড়া বিশেষ ইউনিটগুলো নিজেদের মতো করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য যদি চিকিৎসার মধ্যে থাকেন, তবে তাঁকে ডিউটিতে রাখা উচিত হয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, একজন মানসিক রোগীর কখনোই তাঁর আবেগ বা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কিছু সময়ের জন্য ভালো ব্যবহার করলেও আবার খারাপ আচরণ করে। স্বাভাবিকভাবে চলতে পারলেও কোনটা যৌক্তিক সেটা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু পুলিশের মতো চাকরিতে এমন অসুস্থ মানুষ কখনোই ফিট না। বিষয়টা তাঁর ঊর্ধ্বতনদের আগেই বুঝতে পারা দরকার ছিল।’

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘উন্নত দেশের পুলিশকে প্রতিটি ইভেন্ট মোকাবিলার বা দায়িত্বের জন্য আলাদা কৌশল শেখানো হয়। কিন্তু আমাদের এখনো “ট্র্যাডিশনাল পুলিশিং” চলছে, এর উন্নতি দরকার।’

পুলিশ সূত্র বলছে, গতকাল শনিবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে ফিলিস্তিন দূতাবাসের উত্তর পাশের গার্ডরুমের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কূটনৈতিক জোনের দুই পুলিশ সদস্য। দায়িত্ব ভাগাভাগি নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে কনস্টেবল কাওছার আহমেদ সাব মেশিনগান দিয়ে গুলি চালান। দুটি ম্যাগাজিন থেকে ৩৮ রাউন্ড গুলি চালিয়েছেন তিনি। এতে কনস্টেবল মনিরুল হকের দেহ তাতে ঝাঁজরা হয়ে যায়। এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন তিনি। এতে ওই পথে যাওয়া এক বাইসাইকেল আরোহী গুলিবিদ্ধ হন। আহত ব্যক্তি জাপান দূতাবাসের গাড়ি চালক সাজ্জাদ হোসেন শাহরুখ। তিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

কনস্টেবল কাওছারের হাতে থাকা অস্ত্রটির বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসএমটি ৪০ সাবমেশিন গান দিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন কাওছার। তাঁর কাছে দুটি ম্যাগাজিন ছিল। প্রতিটি ম্যাগাজিনে ৩০টি করে গুলি থাকে। একটি ম্যাগাজিন শেষ হওয়ার পর আরেকটি ভরেন কাওছার। দ্বিতীয় ম্যাগাজিন থেকে ২২ রাউন্ড তাজা গুলি পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ ঘটনায় যে অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি ব্রাজিলের কোম্পানি তরাস আর্মসের তৈরি। পুলিশকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে প্রায় তিন বছর আগে তরাস এসএমটি ৪০ সাম মেশিনগান পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এতে ৯ এমএম গুলি ব্যবহার করা হয়। প্রতি মিনিটে ৬০০–৭০০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে পারে এ মেশিনগান। সাধারণ দায়িত্বে থাকা পুলিশের হাতে এ অস্ত্র দেখা না গেলেও কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের এ ধরনের আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দেওয়া হয়।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!