ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ নরসিংদী থেকে মেইল ট্রেনে চেপে ঢাকা আসছিলেন ৪২ বছরের ঝুমুর কান্তি বাউল। প্রচণ্ড ভিড় আর গরম থেকে বাঁচতে দুই আসনের মাঝখানে থাকা এক জানালার পাশে দাঁড়ান তিনি। সেই দাঁড়ানো নিয়ে তর্ক বাঁধে আরেক সহযাত্রীর সঙ্গে। তর্ক থেকে হাতাহাতি। একপর্যায়ে কিল-ঘুষি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন ঝুমুর। হাসপাতালে নেওয়ার পরে জানা যায়, হৃদরোগের সমস্যায় আক্রান্ত ঝুমুর মারা গেছেন। গত বৃহস্পতিবারের এই নির্মম ঘটনাটি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে।
এই সংবাদটি খবরের কাগজে বা মিডিয়াতে আসছে বলে জানা গেছে, তবে যারা বাংলাদেশে বাস করেন তারা প্রতিনিয়তই এই ধরনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। কোনটা সংবাদমাধ্যমে আসে কোনটা আসে না। কেউ কেউ হয়তো নরসিংদীর ট্রেনের লোকটির মতো এতো দুর্ভাগা হন না। তবে অধৈর্য যাত্রীরা পিটিয়ে বাসের ড্রাইভারকে মারা, চাঁদা চাইতে আসায় ছাত্রনেতাদের মিলেমিশে পিটিয়েছে দোকান মালিকেরা, বাসে ট্রেনে যাত্রীদের প্রবল উত্তেজনায় বড়সড় গন্ডগোল নিয়মিত হয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগে দেশকে আলোড়িত করেছিল ছিনতাইকারী সন্দেহে দুই শিশুর মাকে গণপিটুনিতে হত্যা করা। গণপিটুনি, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ইত্যাদি যেন এদেশে একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। বুনো, ক্ষুধার্ত প্রাণীদের মতো এ দেশের মানুষেরা যেন মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন সহজেই।
ব্যাপারটা বড়সড় সামাজিক সমস্যা এবং এর পিছনে আছে রাজনীতি ও জবাবদিহিতাবিহীন এক সমাজের গল্প। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ধসে পড়ায় এদেশের মানুষ দিশেহারা হয়ে গেছে। কোনোভাবে জানোয়ারসুলভ প্রবৃত্তি নিয়ে টিকে থাকাটাই যেন ভবিতব্য।
হবে নাই বা কেন? দেশে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। অপরাধীদের জবাবদিহিতা নাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। ক্ষমতা ও অর্থ এদেশে যাদের আছে তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাকি মানুষেরা যেন বনের অনিরাপদ শিকার মাত্র। কেউ জানে না কখন ক্ষমতাশালীদের থাবায় তাঁর জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন এক বিরাট হা করা শ্বাপদ। যেই রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে এর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা প্রান্তিক মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া আর সকলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা, সে ঠিক তার উল্টাটা করছে। কখনো রাষ্ট্রের পুলিশ, কখনো বা নিত্যনতুন সব দমনমূলক আইনের শিকার হচ্ছে এর নাগরিকেরা। আর যেইসব দানবেরা এই নাগরিকদের প্রতিনিয়ত শুষে নিচ্ছে তাঁদের উলটা নিরাপত্তা দিচ্ছে। আজিজ-বেনজীর বা অন্যান্য শীর্ষ লুটেরা আর সন্ত্রাসীরা যদিওবা কখনো কিছুটা বিপদে পড়ে, শেষতক তাঁদের তেমন কিছু হয় না। বরং নতুন নতুন আজিজ-বেনজীররা এসে লুটপাট চালায়।
ফলত, পুরো একটা জনগোষ্ঠী বুঝতে পারছে, এই দেশে টিকে থাকার একমাত্র উপায় যে কোন উপায়ে ক্ষমতা অর্জন। সকল ধরনের মানবিক মূল্যবোধ আর ইনসাফের ধারণাকে বিসর্জন দিয়ে কোনোভাবে নিজের হিস্যাটা বুঝে নেয়া। এরজন্য যদি অন্যদের চরম ক্ষতিও করতে হয় তাতে কিছু যায় আসে না।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাজারে গিয়ে যখন দাম শুনে মাথায় আগুন চড়ে যায়, রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায় তখন সে এতোটাই হৃদয়হীন হয়ে পড়ে যে, দরিদ্র রিকশাচালক বা শ্রমজীবীদের পর্যন্ত সে হিংসা করতে শুরু করে। অফিসে কম বেতন, অল্প কয়টা টাকার জন্য তীব্র অপমান, বেকারত্বের গ্লানি, প্রবল ট্র্যাফিক জ্যাম, সব মিলিয়ে অসহ্য সব মানসিক চাপ। এত চাপ সয়ে টেনে নেয়া জীবনটার নাই কোন নিরাপত্তা। এই রাষ্ট্র তাঁকে এক চুল দাম দেয় না। ফলে, প্রবল এক অবিচারের সমাজে বোধবুদ্ধি হারিয়ে সে হয়ে পড়ে পাশবিক, বিকারগ্রস্থ।
গণতন্ত্রের অনেক ত্রুটি আছে কিন্তু এর সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে মানুষকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া। মানুষকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং কাঠামো নির্মাণ। জবাবদিহিতা আর ইনসাফ কায়েম। আমাদের গণতন্ত্রহীনতা আমাদের একইসাথে অসহায় ও হিংস্র করে তুলছে। হিংস্র উপত্যকার এক শ্বাপদসংকুল দেশ হয়ে পড়েছে গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশ।