ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। এরপর থেকে নিজের নামের আগে ডক্টর শব্দটি যুক্ত করেন তিনি। যদিও ডক্টরেট ডিগ্রি নেয়ার প্রোগ্রামে ভর্তির যোগ্যতাই তার ছিল না। শর্ত শিথিল করে তাকে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) প্রোগ্রাম থেকে বেনজীর আহমেদ ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন। সেখানে ভর্তির জন্য স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হয়। শিক্ষাজীবনের সব পাবলিক পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর পেতে হয়। বেনজীরের তা ছিল না।
বেনজীরের ভর্তির ক্ষেত্রে মৌলিক শর্তগুলো শিথিল করা হয়েছিল ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের তৎকালীন ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সুপারিশে। তিনি ছিলেন বেনজীরের ‘ডক্টরেট’ প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক। ২০২০ সালের মে মাসে তিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যান হন। এখনো সেই পদেই রয়েছেন। আর ভর্তি ও ডিগ্রি পাওয়ার সময় বেনজীর ছিলেন র্যাবের মহাপরিচালক। ভর্তির শর্ত শিথিলের ক্ষেত্রে বেনজীরের পদ বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল।
গত মাসে বেনজীর আহমেদের সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। ইতোমধ্যে তার পরিবারের বিপুল জমি, ব্যবসা ও শেয়ার ব্যবসার তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। এসব সম্পদ আদালতের আদেশে জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ মে বেনজীর সপরিবার দেশ ছাড়েন।
আরো পড়ুন: সরকারের সহায়তায় দেশ ছেড়েছে বেনজীর
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে এখন অনুসন্ধান হচ্ছে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ ও অর্থ পাচার বিষয়ে। তবে তথ্য-উপাত্ত পেলে ডক্টরেট ডিগ্রির বিষয়টিও কমিশনের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আসতে পারে। কমিশন প্রতিবেদন গ্রহণ করলে তা এজাহারভুক্ত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) আগে থেকে ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) প্রোগ্রাম চালু ছিল। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ একই প্রোগ্রাম চালুর অনুমোদন পায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে।
২০১৪ সালের ২৪ জুন ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সভায় বেনজীরের ডিবিএ ডিগ্রির আবেদন গ্রহণ করা হয়। অনুষদটির ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধীনে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তিনি ডিবিএ প্রোগ্রামে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন ওই প্রোগ্রামের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া নিয়ে ওই সময় র্যাবের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বেনজীর প্রথম ব্যাচের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে ডিগ্রিটি অর্জন করেন।
বেনজীরের গবেষণার বিষয় ছিল ‘আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর অবদান’।
বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে এখন অনুসন্ধান হচ্ছে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ ও অর্থ পাচার বিষয়ে। তবে তথ্য-উপাত্ত পেলে ডক্টরেট ডিগ্রির বিষয়টিও কমিশনের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আসতে পারে। কমিশন প্রতিবেদন গ্রহণ করলে তা এজাহারভুক্ত হবে।
বেনজীর আহমেদের ডিবিএ ডিগ্রির আবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৮ সালে তিনি গোপালগঞ্জের এস এম মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে এখনকার এসএসসি সমমানের পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৮০ সালে সরকারি জগন্নাথ কলেজ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে এখনকার এইচএসসি সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
বেনজীরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দয়া বিএ (পাস) ডিগ্রি আছে (১৯৮২)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলছেন, তখন এই সনদ পেতেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত শিক্ষার্থীরা পেতেন স্নাতক ডিগ্রির সনদ। বেনজীর কোন কলেজে পড়েছেন, সেটা নথিপত্রে কোথাও উল্লেখ নেই। তবে তিনি ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান।
বিএ (পাস) সনদ অনুযায়ী, বেনজীর মোট ১ হাজার ১০০ নম্বরের মধ্যে ৫১৭ পেয়েছেন (৪৭ শতাংশ)। অর্থাৎ, তিনি ৫০ শতাংশ নম্বর পাননি। কিন্তু ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, তিনি ডিগ্রি বা সমমানের পরীক্ষায় মোট ৫০০ নম্বরের মধ্যে ৩০১ নম্বর (৬০ শতাংশ) পেয়েছেন। তার বিএ (পাস) সনদে সাল উল্লেখ করা হয় ১৯৮২। ডিবিএর আবেদনে সাল বলা হয়েছে ১৯৮৩। এই সালের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো সনদ জমা দেননি তিনি।
বেনজীর কোন কলেজে পড়েছেন, সেটা নথিপত্রে কোথাও উল্লেখ নেই। তবে তিনি ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান।
আরো পড়ুন : বেনজীরের আরো সম্পত্তি ও ফ্ল্যাট জব্দের নির্দেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সনদ অনুযায়ী, বেনজীর ১৯৮৪ সালে ৫০০ নম্বরের মধ্যে ২২৯ পেয়ে (প্রায় ৪৬ শতাংশ) দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হন। অর্থাৎ তিনি ৫০ শতাংশ নম্বর পাননি। ভর্তির আবেদনে তিনি স্নাতকোত্তরে মোট নম্বর দেখিয়েছেন ৫০০-এর পরিবর্তে ৪০০। মানে হলো, পরীক্ষার মোট নম্বর কম দেখিয়ে তিনি ডক্টরেট প্রোগ্রামে ভর্তির শর্ত পূরণের চেষ্টা করেছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল জানান, ঘটনাটি যে সময়ে ঘটেছে, তখন তিনি উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন না। তাই বিষয়টি সম্পর্কে তার জানা নেই। সাধারণভাবে শর্ত পূরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ডক্টরেট প্রোগ্রামে ন্যূনতম নম্বর এবং স্নাতক ডিগ্রি থাকার বাধ্যবাধকতাসহ কিছু মৌলিক শর্ত রয়েছে, যেগুলো শিথিলযোগ্য নয়।
ডিনস কমিটির ২০১৫ সালের ১৪ মে অনুষ্ঠিত সভার নথি বলছে, বেনজীরকে ভর্তির সুযোগ দেয়ার সুপারিশপত্রে বলা হয়েছিল, তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক। সমাজের এ রকম একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে ডিবিএ প্রোগ্রামে বিশেষ বিবেচনায় হলেও ভর্তির অনুমতি দিলে দেশের কল্যাণে কাজে আসবে।
অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ৭ জুন বলেন, ৪০ বছর আগে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তারা কম নম্বর পেতেন। তারা এখন বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ পদে রয়েছেন। বেনজীরের ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছে। তিনি বলেন, বেনজীরের নম্বর কম থাকার বিষয়টি একাডেমিক কাউন্সিলে গেছে। কাউন্সিলে তাকে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়। এখানে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি।