ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃমিডনাইট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লি সফর নিয়ে রাজনীতিতে হিসাব-নিকাশ চলছে। দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার গঠিত হওয়ার পর শেখ হাসিনার সফরে দুদেশের মধ্যকার বিবদমান ইস্যুগুলো বেশি গুরুত্ব পাবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও কার্যত সেটি হয়নি। ওই সফরে ঢাকা-দিল্লি দশটি চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে। সফরে দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সীমান্ত হত্যা ও বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে কোনো কথা হয়নি। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা নদীর পানি চুক্তি থেকে সরে এসে ভারত তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চোখ রাখায় বাংলাদেশ আবারো তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হবে।
ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই দিনের দিল্লি সফরে দুদেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারকসহ ১০টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর মধ্যে পাঁচটি নতুন সমঝোতা স্মারক সই এবং তিনটি পুরোনো সমঝোতা স্মারক রয়েছে। নতুন সই হওয়া দুটি সমঝোতা স্মারক হলো- ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল অংশীদারিত্বের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারিত্বের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।
অন্য পাঁচটি নতুন চুক্তি হচ্ছে- বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ব্লু ইকোনমি এবং মেরিটাইম কো-অপারেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক; ভারত মহাসাগরের সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে যৌথ গবেষণার জন্য বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ওআরআই) এবং ভারতের কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (সিএসআইআর) মধ্যে সমঝোতা স্মারক। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক; যৌথ উদ্যোগে ক্ষুদ্র উপগ্রহ প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য ভারতের ন্যাশনাল স্পেস প্রমোশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সেন্টার (ইন-স্পেস) ও বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। আরেকটি হলো- প্রতিরক্ষা স্টাফ কলেজগুলোর মধ্যে একাডেমিক সহযোগিতা সম্পর্কিত সমঝোতাপত্র।
তিনটি নবায়ন করা স্মারক হলো- মৎস্য খাতে সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমঝোতা স্মারক এবং স্বাস্থ্য ও ওষুধ ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সমঝোতাপত্র।
এর বাইরে তিস্তায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারতের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। তবে বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলবাসীর প্রাণের দাবি তিস্তা নদীর পানি চুক্তির বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত থেকে গেছে। এর পরিবর্তে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর ওই বৈঠকে। তবে এই প্রকল্পে প্রথমে চীনের সঙ্গে সরকারের কথা পাকাপোক্ত থাকলেও নতুন করে দিল্লির সঙ্গে আলোচনায় জড়ালো ঢাকা।
এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিষয়ে একটি বিশেষজ্ঞ দল শিগগিরই ঢাকা সফরে আসবে। তারা নদীর পানি সংরক্ষণ, পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিবে। পরে দুই দেশ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
এদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে দুই দেশ ব্যস্ত হওয়ায় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি ঝুলে গেলো কি না এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। আজ রোববার তিনি বলেন, এটি বলার জন্য আমি সঠিক কর্তৃপক্ষ নই। আমি শুধু এটুকু বলবো, নদীর পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকা-দিল্লি বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হওয়ার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত ছিল। তবে শেষ মুহূর্তে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তির কারণে সেটি আটকে যায়। তারপর থেকে ভারত একতরফাভাবে তিস্তা থেকে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। এমনকি গত বছর নতুন করে আরো দুটি খাল খনন করে পানি প্রবাহ সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা পানি না থাকায় উত্তরের কৃষিকে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তা নদীর পানির অধিকার থেকে বাংলাদেশের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে সরিয়ে রাখতেই ভারত তিস্তা মহাপরিকল্পনায় নজর দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে বাংলাদেশকে ঘায়েলের নীতি গ্রহণ করায় আমরা পানি বঞ্চিত থাকছি।
এ বিষয়ে নদী গবেষক রিভারাইন বাংলাদেশের পরিচালক অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ভারত মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দোহাই দিয়ে এতোদিন চুক্তিটি করেনি। এখন তারা এ থেকে সরে এসে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা বলছে। অথচ পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের অধিকারের বিষয়। চুক্তি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া সাবেক কূটনীতিক তৌহিদ হোসেন বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা ও তিস্তা নদীর পানি চুক্তি দুটি ভিন্ন বিষয়। ভারত নতুন ইস্যুতে যুক্ত হওয়া মানে এই নয় যে ঢাকা তার পুরোনো ইস্যুকে ভুলে যাবে। পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন করতে ঢাকাকে কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।