ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারতকে দেওয়া স্থল এবং নৌ ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা করিডোর সুবিধা থেকে বিলিয়ন ডলার আয় হবে— এই খোয়াব আগেও শুনানো হয়েছে। এবারও রেল ট্রানজিট/ট্রান্সশিপমেন্ট/করিডোর প্রশ্নে কেউ কেউ এসব যুক্তি উঠাচ্ছেন। কেউ কানেকটিভিটি, কেউ প্রোডাক্টিভিটি অথবা যাত্রী পরিবহণের মতো বিষয় সামনে আনছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, ২০ ভাগের একভাগ (কোথাও ১০ ভাগের একভাগ) টোল হলেও ভারতের ব্যবসায়ীরা এসব ব্যবহার করছে না কেন? (বিস্তারিত এক- 'নামমাত্র খরচে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করবে ভারত', শেয়ারবিজ, ২৭ এপ্রিল ২০২৩. দুই- '২০১০-এ ট্রানশিপমেন্ট ফি ছিল ১০ হাজার, এখন ৫০০ টাকা। ২০১০-এর নির্ধারিত চার্জের তুলনায় বর্তমানে ২০ ভাগের এক ভাগ ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ আদায় করা হয়েছে।'- শেয়ারবিজ ২২ জুলাই ২০২০)
বাস্তবে স্থল, নৌ এবং রেল ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট কিংবা করিডোর যাই বলুন না কেন এগুলোর মূল উদ্দেশ্য বাণিজ্য নয়, বরং এসব ভারতের সামরিক এবং নিরাপত্তা সমাধান। যেহেতু এসবের বাণিজ্যিক আবেদন কম বা আদৌ ইউজকেইস তৈরি করা হয়নি, এখান থেকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আসছে না।
আর নৌ ট্রানজিটের ক্ষেত্রে আয় এতই কম যে, আয় দিয়ে ড্রেজিং খরচও ওঠে না। একইভাবে সড়ক ও বন্দরের ক্ষেত্রেও রুট নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং নিরাপত্তার কোনো খরচই ওঠার বিজনেস কেইস তৈরি হয়নি।
এখানে পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি আসলেই চায় বাংলাদেশ ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট ও করিডোর থেকে বিপুল ফরেন কারেন্সি আয় করুক? সেটা চাইলে ট্রান্সশিপমেন্ট/ট্রানজিট ফি থেকে আসা রাজস্বে আমরা প্রতিফলন দেখতাম নিশ্চয়ই!
উদাহরণ হিসেবে ফেনী ব্রিজের কথা বলা যায়, বাণিজ্যিক ফিজিব্যালিটি না থাকা সত্ত্বেও ফেনী নদীর উপর দিয়ে কয়েকশ’ কোটি টাকা খরচ করে ফেনী ব্রিজ ও ফেনী-ত্রিপুরার জন্য সড়ক তৈরি করে দেওয়া হল। বলতে গেলে এই রুটে কোনো আন্তঃদেশীয় ট্রাকই চলে না।
একটা রুট সচল করতে লেনদেন লাগে, একতরফা আমদানি করলে/উল্লেখযোগ্য রপ্তানি না হলে, বন্দর বলুন আর ট্রানজিট রুট বলুন- এসবের বাণিজ্যিক ফিজিবিলিটি আসে না। (একই কারণে মোংলা বন্দর অকার্যকর, ভরা জাহাজ আসলে খালি যেতে হয় বা ভাইস-ভারসা)।
উল্লেখ্য যে, যাত্রী পরিবহণের জন্য ইতোমধ্যেই ১৯৬৫ সালের আগের রেলগুলো সচল করা হয়েছে। এতে চিকিৎসা, ভ্রমণ, মেডিক্যাল টুরিজম এবং শপিংয়ের উদ্দেশে ভারত গমন বেড়েছে। এমনকি ১৯৬৫ সালের আগের সবগুলো রেললাইন সচল করার বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবেই কোনো প্রতিবাদ কেউ করেনি। এখন কেন করছে?
আগের দেওয়া ট্রানজিট, করিডোর/ট্রান্সশিপমেন্ট বা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটির এলিমেন্ট উইন-উইন হলে নতুন রেল সংযোগের বাণিজ্যিক আলাপ তোলা যেত। অবশ্যই নতুন কেস স্ট্যাডি করা যেত। যেমন—
ক। শুধু যাত্রী পরিবহণ দিয়ে রেল বাংলাদেশে কখনও লাভজনক হয়নি।
খ। গত ১০ বছরে ভারত থেকে আমদানি ৩ গুণ হয়েছে, অর্থাৎ বিদ্যমান স্থল ও নৌ বন্দর অবকাঠামো ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য বিকাশে কোনো ব্যারিয়ার হয়নি যে নতুন করে রেল লাগবে। আসলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশের তিন দিকে এত বেশি স্থলবন্দর এবং একাধিক নৌ বন্দর আছে যে, বাণিজ্যের জন্য ট্রানজিট ট্রানশিপমেন্ট করিডোর আলাদাভাবে লাগে না।
বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ভারত বাংলাদেশের মধ্যে অন্তত ২৩টা ছোট বড় স্থলবন্দর আছে। নদিয়া জেলার সীমান্তে প্রস্তাবিত দুটি—মুজিবনগর স্থলবন্দর এবং প্রাগপুর স্থলবন্দর হলে সে সংখ্যা গিয়ে ২৫ এ দাঁড়াবে। তাই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে অবকাঠামোগত কোনো বাধা নেই এটা নিশ্চিত। তাহলে নতুন করে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্টের প্রয়োজন কেন? কারণ ভারতের নিরাপত্তার জন্য, সামরিক প্রয়োজনে এই করিডর ট্রান্সশিপমেন্ট। এখান থেকে বাংলাদেশের আয়ের আলাপ ফালতু ব্যাপার।
অবশ্যই ভারতের নিরাপত্তা প্রয়োজন, সামরিক প্রয়োজনের সমাধান বাংলাদেশ করতে পারে! কিন্তু সেটা যৌক্তিক ও ন্যায্য প্রাপ্তির বিনিময়ে হতে হবে না? প্রশ্ন হচ্ছে, বাণিজ্যে, পানিতে, নদীতে বাঁধ ও ভাঙন রোধে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষতি কমাতে, সীমান্ত হত্যা থামাতে, কিংবা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষের ভারত থেকে প্রাপ্তি কি?
উল্লেখ্য, ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারত থেকে ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয়েছিল। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে ভারত থেকে সেই আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে। বাণিজ্যের ট্রেন তো থেমে নেই!
[নোট- হ্যাঁ, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রেখেও ট্রানজিট ট্রান্সশিপমেন্ট করিডর দেওয়া যায়। কিন্তু গত ১০ বছরে বাংলাদেশের তিন শতাধিক নাগরিককে সীমান্তে যে দেশ খুন করেছে, যে দেশ বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যার কারিগর, তাকে ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।
ফরেন কারেন্সি আসলে, সামরিক সমাধানের বিপরীতে আমাদের পানি আসলে (যদিও এটা অধিকার আমাদের), বন্যা ক্ষতি কমলে, গণতন্ত্র হত্যা ও ভোটাধিকার হরণ বন্ধ হলে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে গোয়েন্দা ইনফিল্ট্রেশান বন্ধ হলে, সর্বোপরি নিজের নিরাপত্তা এবং রাজনীতি প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকলে- বাংলাদেশের সিকিউরিটি কন্ডিশন মেনে ভারতের সামরিক পরিবহন দেশের ভেতর দিয়ে গেলে সমস্যা নাই। কিন্তু নূন্যতম প্রাপ্তি না হলে, নির্বাচনী ব্যবস্থা অকার্যকর করে, গণতন্ত্র হত্যা করে দাস সরকার প্রতিষ্ঠা করে, মানবাধিকার হরণ করে, সীমান্তে হত্যা চালিয়ে- একতরফা সব সুবিধা দিতে গেলে ডেফিনিটলি তীব্র আপত্তি আছে।]
গ। বাংলাদেশ রেলের অন্তত শতাধিক সেতু ব্রিটিশ আমলের। সরকারি হিসেবে মোট সেতুর ৩৫%, বেসরকারি হিসেবে ৫০%। ঘাটতি বাজেটের কারণে সেসবে অর্থায়নের অভাব আছে।
ঘ। বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের ডেবট সার্ভিসের ক্রাইসিসে পড়ছে, এমতাবস্থায় ভারতের চিকেন নেকের সুরক্ষার জন্য কানেক্টিভিটির প্যাকেজে আসা নতুন রেলের জন্য বিদেশি ঋণের উল্লেখযোগ্য দায় বাংলাদেশের উপর আসবে।
সবমিলে, আমরা মনে করি না, ভারত ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য এমন উল্লেখযোগ্য কোনো ফি দেবে যা দিয়ে অপারেশন কস্ট, সিকিউরিটি এবং লোনের দায় উঠে আসবে। বস্তুত ট্রানজিট ট্রানশিপমেন্ট ও করিডরের উদ্দেশ্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নয়, এমনকি ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহনের বিষয়টাও মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং মূল উদ্দেশ্য ভারতের নিরাপত্তা সমাধান এবং সামরিক প্রয়োজন।
সম্ভাব্য কোনো আঞ্চলিক সংকট এবং উত্তরপূর্ব ভারতের নিরাপত্তা প্রশ্নে ভারতের একটা স্থায়ী ভয় হচ্ছে, বহিঃশক্তি শিলিগুড়ি চিকেন নেক বন্ধ করে সেভেন সিস্টারের রাজ্যগুলোকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এজন্য বাংলাদেশের দুর্বল সরকারকে চাপ দিয়ে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সব এক্সেস পেতে তারা মরিয়া, যা সেভেন সিস্টার্সে সংকটকালীন মোবিলাইজেশনের পথ পরিষ্কার করবে।