DMCA.com Protection Status
title="৭

দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধঃ যুক্তরাষ্ট্র কি শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের সমালোচনার মূল্য দিচ্ছে?

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোয়িং উড়োজাহাজ ব্যবহার করে। বিমান বাংলাদেশের কিছু ড্যাশ-৮ টার্বোপ্রপসসহ  ২০টিরও বেশি বিমান রয়েছে। এর বেশিরভাগই প্রশস্ত দেহের বোয়িং প্লেন। তবে সম্প্রতি চারটি ইউরোপিয়ান এয়ারবাস বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।

সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিমান তার নিজস্ব মূল্যায়ন কমিটির বিরুদ্ধে গিয়ে ওয়াইড বডি বা প্রশস্ত দেহের এয়ারবাস এ-৩০ প্লেন কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। বিমান তার নিজস্ব মূল্যায়নে বলে, ‘বিমান বাংলাদেশ’ এয়ারবাস বিমান কিনলে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তবে সরকার আরেকটি মূল্যায়ন কমিটি নিযুক্ত করেছিল। চলতি বছরের এপ্রিলে সেই মূল্যায়নে বলা হয়, এয়ারবাস বিমান কিনলে বিমানের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে।

পরে সরকার প্রথম মূল্যায়ন রিপোর্ট বাদ দিয়ে দ্বিতীয় মূল্যায়নটা রিপোর্ট আমলে নেয়। প্রতিটি ১৮০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এয়ারবাস বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর সঙ্গে অ-ফেরতযোগ্য ৫ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি ফি সম্পৃক্ত আছে। ডলার সংকের মধ্যে বাংলাদে এই এয়ারবাস বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের লাভের অর্থ দেশে পাঠাতে পারছে না।

বিমানের বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিজুল আজিম আনুষ্ঠানিক এক বিবৃতিতে বলেন, বোয়িংকে ঘিরে সাম্প্রতিক নিরাপত্তা উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এড়াতে এয়ারবাস প্লেন ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এয়ারলাইন্সের বহরে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে বিমান তার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইছে। তার যুক্তি ভিত্তিহীন নয়। বোয়িং দুর্ঘটনা, তাদের বিমানের ত্রুটি এবং গ্রাহকদের কাছে বিমান সরবরাহের ধীরগতির কারণে গুরুতর বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

ফলস্বরূপ, বোয়িং বিশ্বব্যাপী ৩২ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। আবার অনেকেই গ্রাহক তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এরমধ্যে সৌদি আরব সম্প্রতি ১০৫টি এয়ারবাস বিমানের জন্য একটি অর্ডার দিয়েছে৷  তবে এয়ারবাস বিমান কেনার সিদ্ধান্ত বিমান বাংলাদেশের আর্থিক বা ব্যবসায়িক যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত নয়।

মনে করা হচ্ছে, এটি ভূ-রাজনীতি এবং বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বাংলাদেশের কাছে  এভিয়েশন সেক্টরে ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া নতুন কিছু নয়।

এভিয়েশন গবেষকদের মতে, এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি পরিষেবা পণ্য সম্পর্কিত বেশিরভাগ ব্যবসার থেকে আলাদা কারণ এটি সরাসরি জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং দেশের প্রতিপত্তির সাথে জড়িত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বেসামরিক বিমান চালনার রাজনীতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে।  সরকার সেই দেশকে কীভাবে দেখে এবং দেশের  নাগরিকরা তাদের নিজস্ব এবং বিদেশি দেশগুলোকে কীভাবে দেখে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের  যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে । যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ২০২১ সালে বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর বেশ কয়েকজন শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। জাতীয় নির্বাচনের আগে ভিসা বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছিল দেশটি। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের কড়া জবাব দিয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম না করে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, একটি দেশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তিমুর-লেস্তের মতো একটি বিমান ঘাঁটি এবং একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করছে। যদিও মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

বোয়িং থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সম্ভবত সাম্প্রতিক মার্কিন সিদ্ধান্তের প্রতি ঢাকার প্রতিক্রিয়ার অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।

এয়ারবাস বিমান কেনার উদ্দেশ্য ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে। এয়ারবাস কেসটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি ফাটলও তুলে ধরে।

বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গে সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র এক বিবৃতিতে বলে, বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু নয়। তবে

অপরদিকে ইউরোপীয় দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গভীর করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কম কঠোর ছিল। তারা শুধুমাত্র সীমিত অংশগ্রহণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে সরকারকে বৃহত্তর স্বচ্ছতার দিকে কাজ করার ও  গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েই তারা দায় সেরেছে। আর

২০২৩ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ১০টি এয়ারবাস বিমান বিক্রির ঘোষণা দেন।

সফর শেষে যৌথ বিবৃতিতে ম্যাক্রন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিলেন। তিনি শুধু ‘সমৃদ্ধি, শান্তি এবং জনগণ- এর কথা উল্লেখ করেছিলেন।

ফ্রান্সের বাংলাদেশের কাছে এয়ারবাস বিমান বিক্রি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিকে মার্কিনিদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেব। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে এই বৈরিতা শেখ হাসিনাকে সুবিধা দিয়েছে। অন্তত এয়ারবাস বিমান কেনার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে গণতন্ত্রের জন্য চাপ কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!