ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এক কোটিরও বেশি মানুষকে প্রায় ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। আর এই জন্য ব্যাংকটি কোনো জামানত নেয়নি। অংকের হিসাবে এটা অনেক বড় লেনদেন হলেও, ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসের এখনো মনে আছে, তার প্রথম দেওয়া ঋণ ছিল মাত্র পাঁচ ডলার।
১৯৭৪ সালের কথা। ইউনুস সদ্যই যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশে মাত্র তিন বছর আগে রক্তাক্ত গণযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছে। ইউনূস দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু রোজকার দারিদ্র্য ও ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের মুখে তার সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ৮৩ বছর বয়সী ইউনূস টাইম ম্যাগাজিনকে জুম সাক্ষাৎকারে বলেন তিনি মনে কলিছেন, অর্থনীতি অর্থহীন বিষয়। সেসব ছিল শূন্য ধারণা, যা ক্ষুধার্ত মানুষকে কিভাবে খাদ্য পেতে সাহায্য করে তা আমাকে শেখায়নি।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে সেই সমস্যার ব্যবহারিক সমাধান খুঁজতে হাঁটতে বের হন তিনি। হঠাৎ তিনি দেখেন এক নারী বাঁশের বেত দিয়ে মোড়া তৈরি করছেন। কথা বলে জানতে পারেন, ওই মোড়া বানাতে ৫ ডলারের মতো খরচ হয়। আর এই টাকা তিনি মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেন। বিনিময়ে যে মোড়া তৈরি করেন তা তার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন। খোলা বাজারে বিক্রি করতে পারেন না। এর মধ্য দিয়ে পণ্যের মূল্য মহাজন নিয়ন্ত্রণ করেন।
স্মৃতিচারণ করে ইউনূস বলেন, আমি বলি এটা দাসত্ব, এটা কোনো ব্যবসা নয়। ৫ ডলারের বিনিময়ে কেউ একজন এমন একটি সুন্দর দক্ষতাকে দাসত্বে পরিণত করছে। ইউনূস ওই নারীকে ৫ ডলার ঋণ দিতে চান এবং সুবিধাজনক সময়ে ওই নারীকে সেই অর্থ ফিরিয়ে দিতে বলেন। গ্রামের অন্য নারীদেরও তিনি তার কাছে ঋণ নিতে আসতে বলেন। এমনই করে ৪২ জনের একটি দলকে তিনি ২৭ মার্কিন ডলার ঋণ দেন। সেই খুব সাধারণ একটি উদ্যোগ থেকে মাইক্রোক্রেডিট (ক্ষুদ্রঋণ) প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং যার সফলতাই ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইউনূসের শুরু করা সেই ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি এখন বিশ্বের শতাধিক উন্নয়নশীল দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চলছে। ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে প্রথম অফিস খোলা হয়। আমেরিকার ৩৫টি শহরের সংখ্যালঘু নারীদের ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে। শুধ গত বছরই দেওয়া হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার; যার ফেরতের হার ৯৯ শতাংশ। গ্রামীণের দেওয়া মোট ঋণের ৯৪ শতাংশেরও বেশি নারীদের দেওয়া হয়েছে।
যেসব মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তাদের কাছে ইউনূসের এই চিন্তাধারা তাকে ‘গরিবের ব্যাংকার’ করে তুলে। বিশ্বজুড়েও তার প্রশংসার কমতি ছিল না। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার, ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বাধীনতা পদক এবং এক বছর পরে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল পান তিনি।
তারপরও ইউনূস আজকে একজন অপরাধী। হোয়াইট হাউসের গোলাপ বাগিচায় ঘুরে বেড়ানো নয়, বরং আক্ষরিক অর্থে ঢাকার কোর্টরুমে তাকে বন্দি অবস্থায় দেখা যায়। জানুয়ারিতে, ইউনূস এবং তার টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও তাদের তাৎক্ষণিক জামিন দেওয়া হয়েছিল। যদিও অর্থ জালিয়াতি, অর্থ নয়ছয় এবং আত্মসাৎসহ ২০০টিরও বেশি মামলার মধ্যে সেটি ছিল মাত্র একটি। ইউনূস ক্রমবর্ধমানভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
গত আগস্টে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন সহ শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১৭০ জন বিখ্যাত মানুষ এক খোলা চিঠিতে ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘ধারাবাহিক বিচারিক হয়রানি’ বন্ধে শেখ হাসিনাকে আহ্বান জানান। জুনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, এই মামলাগুলো ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখাতে বাংলাদেশের শ্রম আইনের অপব্যবহারের উপস্থাপন হতে পারে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই আচরণকে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকারের বিপর্যস্ত অবস্থার প্রতীক হিসেবে গণ্য করে, যেখানে কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতাকে হরণ করেছে এবং সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছে।
তারপরও কিছুই শেখ হাসিনার ক্রোধকে প্রশমিত করতে পারে না। ২০১১ সাল থেকে তিনি ইউনূসকে দরিদ্রদের ‘রক্ত চোষা’ হিসাবে উপহাস করে আসছেন এবং একই বছর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের করেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সন্তানটির বিরুদ্ধে তার ক্রুসেডের নেপথ্যে কি লুকিয়ে আছে ? তা ট্রিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন' বলেছেন ইউনূস। তার মতে, ‘কেউ এর উত্তর জানে না; কিন্তু এটা চলতেই থাকবে।’
সত্যটি বড় জটিল, এখানে আছে ব্যক্তিগত ঈর্ষা। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভয়াবহরকমের অবনতি, সেইসাথে একটি স্বতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী অঞ্চল জুড়ে আমেরিকান প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে। প্রথমত, এটি ওপেন সিক্রেট যে শেখ হাসিনার ঈর্ষার কারণ হলো ইউনূসকে বারবার দমনের চেষ্টার পরও তিনি শান্তিতে নোবেল জিতেছেন। শেখ হাসিনা এই পুরস্কারের জন্য গভীরভাবে ব্যাকুল। তিনি প্রথমবার ভেবেছিলেন, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিতে আলোচনার জন্য এবং তারপর ২০১৭ সালে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া জন্য নোবেল পাবেন। নরওয়ের নোবেল কমিটি কর্তৃক তাকে স্বীকৃতির অভাবের বিষয়ে বাংলাদেশের সম্পাদকীয় এবং সরকারি বড় বড় ব্যক্তিরা নিয়মিত বিলাপ করে থাকেন।
আরেকটি প্রধান কারণ হলো ইউনূসকে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেয়। তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দেন। তবে মাত্র ১০ সপ্তাহ পরই ইউনূস তার সেই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিহার করেন। ইউনূস বলছেন, ‘হাসিনা আমাকে রাজনীতিতে আসার জন্য আজও অভিযুক্ত করছেন, যেন রাজনীতিতে আসাটা অপরাধ।’
যখন ইউনূস তার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন তখন শেখ হাসিনা সামরিক বন্দী ছিলেনঅ পুরো বিষয়টিকে তিনি চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন। তাই কখনই ইউনূসকে ক্ষমা করতে পারেননি তিনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, ‘শেখ হাসিনা এটা খুব খারাপভাবে নিয়েছেন যে, ইউনূসকে রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাই ইউনূসকে অপমান করার, তাকে জেলে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে চলেছেন।’
তারপর থেকে যখনই কোনো ঝামেলা হয়, বিশেষ করে বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা সংশ্লিষ্ট কিছু ঘটে তখন ইউনূসের দিকে আঙুল তোলেন শেখ হাসিনা। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন উৎসে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। (প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় তহবিল দিয়ে ২০২২ সালের জুন মাসে সম্পন্ন হয়েছিল) হাসিনা বারবার বিশ্বব্যাংকের ঋণ আটকে দিতে ইউনূস অভিজাত সূত্রগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন অভিযোগ করেছেন এবং এর প্রতিশোধ হিসেবে গ্রামীণ থেকে ইউনূস বিতাড়িত হন। যদিও ইউনূস এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এমনকি ২০২২ সালের মে মাসে আওয়ামী লীগের এক সভায় শেখ হাসিনা বলেন, ইউনূসকে পদ্ম নদীতে দুইবার চোবানো উচিত। একবার একটু চুবিয়ে টেনে তুলতে হবে যেন সে মরে না যায়। তারপর তাকে টেনে পদ্মা সেতুতে নিতে হবে। তাহলে হয়তো তাকে একটা শিক্ষা দেওয়া যাবে।
ইউনূসকে আক্রমণ করার কোনো সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি। ২০১২ সালের এপ্রিলে ইউনূস উগান্ডায় সমকামীদের বিচারের সমালোচনা করে অন্য তিনজন নোবেল বিজয়ীর সঙ্গে একটি যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। এক বছরেরও বেশি সময় পরে বিষয়টিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রচালিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন হাতিয়ার করে। তারা ইউনূসকে ‘সমকামিতাকে সমর্থন করার জন্য ধর্মত্যাগী’ হিসেবে নিন্দা করে গণ-সমাবেশের আয়োজন করেছিল।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইউনূস বলেন, ‘তারা আমাকে একজন 'সুদখোর' বলে অভিযুক্ত করে। এটি সর্বোচ্চ খারাপ একটি কাজ যা একজন মুসলিম করতে পারে, দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে সুদ নেওয়া।'
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্ষুদ্রঋণের ধারণাটি কলঙ্কিত হয়েছে। অসাধু অপারেটররা দ্রুত আবির্ভূত হয়ে ‘মাইক্রোক্রেডিট’কে প্রথাগত লাভজনক ঋণদান পরিষেবাগুলোতে পরিণত করতে প্রচুর স্কিম এবং নেতিবাচক কভারেজ তৈরি করেছে। ইউনূস দীর্ঘকাল ধরে লাভজনক স্কিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। ইউনূস বলেছেন, ‘আইপিও-এর উদ্দেশ্য হলো লোকদের জানানো যে, আপনি দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এটি মহাজনী ক্ষুদ্রঋণ।’
শেখ হাসিনা আজকে ক্ষুদ্রঋণের সবচেয়ে স্পষ্টবাদী সমালোচকদের একজন। কিন্তু ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইউনূস ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি ক্ষুদ্রঋণ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেখানে হাসিনা সহ-সভাপতি ছিলেন। হাসিনা নিজের বক্তব্যে ইউনূসের কাজের প্রশংসা করেন এবং পৃথিবীর বুক থেকে সামগ্রিক দারিদ্র্য হ্রাস ও নির্মূল করার প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ক্ষুদ্রঋণ সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। ইউনূস ছিলেন হাসিনার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার নায়ক এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কট্টর সমর্থক। টেনেসিতে শিক্ষকতা করার সময় ইউনূস একটি নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন, বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে একটি নিউজলেটার প্রকাশ করেন।শেখ মুজিব যদি জানতেন তাহলে তার মেয়ের প্রতিহিংসার কথা শুনে কী করতেন ? জানতে চাইলে ইউনূস বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে তিনি বিরক্ত হতেন।’
নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিক কয়েক দশক ধরে হাসিনার রাজনৈতিক গতিপথে- যার মধ্যে রয়েছে সামরিক হস্তক্ষেপ এক ডজনেরও বেশি গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা এবং নিয়মিত রাজনৈতিক রক্তপাতের ঘটনা- তাকে কঠোর করেছে, ব্যক্তিগত অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তার শাসনের বিগত ১৫ বছরে তিনি রাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত যন্ত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন, সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য বিচার বিভাগ। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো ‘বিচারিক হয়রানি’। কয়েকদিনের মধ্যে তাকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং জীবনের হুমকির কারণে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে অল্প সময়ের জন্য আশ্রয়ও নিয়েছিলেন।
ইউনূসের দুর্দশায় সম্ভবত ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতিতেও অবদান রাখছে। আন্তর্জাতিকভাবে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলাদেশি ইউনূস। তিনি বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে একজন ‘বন্ধু’ হিসাবে গণ্য করেন। আসলে ইউনূস ক্রমবর্ধমান উত্তেজনাপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাঝে পড়ে গেছেন। বাংলাদেশে মানবাধিকারের ক্রমশ অবনতির চিত্রের মধ্যে যেখানে লক্ষাধিক বিরোধী কর্মী রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার সম্মুখীন হয়েছেন এবং ২০০৯-২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ২৫০০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। বাইডেন প্রশাসনের সর্বশেষ দুটি গণতন্ত্র সম্মেলনে হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গত বছরের মে মাসে ওয়াশিংটন জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনকে ক্ষুণ্ন করে এমন যেকোনো বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করে। জবাবে, হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ‘গণতন্ত্র দূর করার চেষ্টা করছে’।
হাসিনা আমেরিকার চাপে পড়ে নড়বড়ে হননি বরং বিরোধীদের বয়কট করা ব্যালটে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। স্বাধীন বা ন্যায্য হয়নি বলে যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনের নিন্দা করেছে। তবুও নতুন ‘জনরায়’ হাসিনাকে উৎসাহিত করেছে। একটা ধারণা আছে, যখনই যুক্তরাষ্ট্র হাসিনার ওপর কোনো আঘাত করে তখনই তার জন্য ইউনূসকে দায়ী করা হয়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, ইউনূস নিজেই এই পথ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে সরব না হয়ে ইউনূস নীরব থেকেছেন। প্রকাশ্যে হাসিনার নিন্দা বা কথা বলতে অস্বীকার করেছেন। আজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইউনূসের খুব কম বন্ধু আছে এবং বিদেশে তার বন্ধুদের প্রভাব কমছে।
নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক মুবাশ্বার হাসান বলেন, ২০১৮ সালে স্পষ্টভাষী বাংলাদেশী ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমকে সরকারের সমালোচনা করার পরে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল। তখন জনসাধারণের ক্ষোভ এতটাই উগ্র ছিল যে কর্তৃপক্ষ তাকে ১০৭ দিন পরে জামিনে মুক্তি দেওয়ায় রীতিমতো চাপ অনুভব করেছিল। সেখানে ইউনূসের দুর্দশার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মাত্র ৫-১০% মানুষ। গুটিকয়েক সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের মানুষ ছাড়া আর কেউ তার পেছনে নেই। তিনি বাংলাদেশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
মুবাশ্বার হাসান নিজেও ২০১৭ সালে গোপন সামরিক কারাগারে ৪৪ দিন বিচারবহির্ভূত বন্দী ছিলেন। তিনি বলেন, ইউনূস তার অসাধারণ বৈশ্বিক প্রোফাইল ব্যবহার করে বাংলাদেশের ক্রমশ পতনশীল মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর আলো ফেলতে পারতেন। জানুয়ারিতে তার বিরুদ্ধে আদালতের রায়ের পরে তিনি মুখ খুলতে শুরু করেন।
হাসানের মতে, ‘ইউনূস ভেবেছিলেন তার প্রভাবশালী সূত্রগুলো হয়তো তার সুরক্ষা হিসেবে কাজ করবে। তিনি ভুল হিসাব করেছেন। কারণ ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে সরকার অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। ইউনূস যে নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে মনে করতেন তা হিতে বিপরীত হয়েছে।
ইউনূস জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন। যদিও আজ তিনি দেখছেন তার ভাগ্য স্বদেশীদের সাথে জড়িয়ে যাদের তিনি আজীবন সাহায্য করে গেছেন । বিদেশে আরামদায়ক পদের অফার থাকা সত্ত্বেও, তিনি তার নামের ওপর থেকে বদনাম সরাতে বাংলাদেশে থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ-এমনকি যদি জেলও হয় তাহলেও তিনি পিছপা হতে রাজি নন। নোবেলজয়ী ইউনূসের কথায়, ‘আমি কেবল জেলের সাজা এড়াতে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারি না। কারণ এটা আমার সারাজীবনের কাজ। যে মুহূর্তে আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিব, এসব কিছুই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
(টাইম সাময়িকী থেকে অনুবাদ)
চার্লি ক্যাম্পবেল, টাইমের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সিঙ্গাপুর ব্যুরোতে কাজ করেন।