DMCA.com Protection Status
title="৭

এস আলমের কর ফাঁকি ৩৫৩১ কোটি টাকা, সরকারের পাওনা ৭০৬৯ কোটি

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ এস আলম গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ভ্যাট ফাঁকি এবং এর জরিমানাসহ সরকারের পাওনা সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। এনবিআরের ভ্যাট শাখার একটি অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভ্যাট রিটার্নে কম ক্রয়-বিক্রয় দেখানোসহ বিভিন্ন উপায়ে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেড ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।

অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে কোম্পানি দুটি তিন হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট 'ফাঁকি' দিয়েছে। আর এর জন্য তাদের আরও তিন হাজার ৫৩১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। দেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ফিল্ড অফিস থেকে অডিটটি করা হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি এটি পর্যালোচনা করে ভ্যাট 'ফাঁকি'র এই অভিযোগের সত্যতা পায়।

২০২৩ সালের অক্টোবরে জমা দেওয়া অডিট প্রতিবেদন এবং প্রতিবেদন তৈরির প্রায় আট মাস পর ২০২৪ সালের মে মাসে জমা দেওয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে তিন বছরে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের বিরুদ্ধে এক হাজার ৯১৭ কোটি টাকা এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডের বিরুদ্ধে এক হাজার ৬২১ কোটি টাকা ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

দুটি কোম্পানিই কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। ভ্যাট রিটার্ন এবং তাদের সিএ ফার্মের অডিটকৃত আর্থিক বিবরণী ও পর্যালোচনা কমিটির কাছে তাদের লিখিত জবাব বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পেয়েছে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ।

কোম্পানি দুটির বিষয়ে গত বছরের অডিট প্রতিবেদন ২ অক্টোবর জমা দেয় অডিট টিম। পরে প্রতিবেদনটি পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়। গত ২১ মে জমা দেওয়া পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে 'ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে'।

এদিকে, গত ৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস, ভ্যাট ও এক্সাইজ কমিশনারেট ওই দুই কোম্পানিকে পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে 'ফাঁকি দেওয়া' তিন হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা ভ্যাট, তিন হাজার ৫৩১ কোটি টাকা জরিমানা এবং এর ওপর প্রযোজ্য সুদের টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে পরিশোধের নির্দেশ দেয়।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, এই টাকা পরিশোধের দেওয়া নির্ধারিত সময় শেষ হবে ৩ জুলাই। এর মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল না করলে মাঠ পর্যায়ের অফিস ওই দুই কোম্পানির বিরুদ্ধে 'আইন অনুযায়ী ভ্যাট, জরিমানা ও সুদের টাকা আদায়ে ব্যবস্থা নেবে'।

গত ২৭ জুন এস আলম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) সুব্রত কুমার ভৌমিক জানান, তারা 'ভ্যাটের একটি টাকাও ফাঁকি দেননি' এবং এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।

ব্যবসায়ীক গ্রুপটির এই দুই অঙ্গ সংগঠন ভ্যাট দাবির ২০ শতাংশ—৭০০ কোটি টাকার বেশি—পরিশোধ করে ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারবে।

এস আলম গ্রুপের কোম্পানি আইনজীবী মো. মুস্তাফিজুর রহমান গত ২৯ জুন জানান, তারা আপিল করার আগে ভ্যাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত শুনানির মাধ্যমে তাদের পূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানাতে এবং অডিট ও পর্যালোচনার সময় কর্তৃপক্ষের চাওয়া নথি উপস্থাপন করতে চায়।

ভ্যাট কর্তৃপক্ষ অনাদায়ী ভ্যাট পরিশোধ করতে বলার তিন দিন আগে—গত ৬ জুন—পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য আবেদন করলেও তাদেরকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে মুস্তাফিজুর বলেন, 'তারা যদি পূর্ণাঙ্গ শুনানি করে এবং আমাদের পর্যাপ্ত সময় দেয় তাহলে বোঝাতে পারব, তারা যে ভ্যাট দাবি করছে তা বাস্তব সম্মত নয়।'

পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক এবং আয়কর ও ভ্যাট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া সব বাণিজ্যিক নথিতে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্রয় ও বিক্রয় তথ্য একই হতে হবে। এর অর্থ হলো, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি একটি আইনি বাধ্যবাধকতা যে, ভ্যাট অফিস, আয়কর অফিস, ব্যাংক এবং সিএ ফার্মের মাধ্যমে অডিটকৃত আর্থিক প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা ক্রয় ও বিক্রয়ের তথ্য 'অভিন্ন হতে হবে'।

উভয় কোম্পানির ক্ষেত্রে পর্যালোচনা কমিটি বলেছে, 'প্রতিষ্ঠানের লিখিত জবাব, মূসক এবং আয়কর দপ্তরে সংরক্ষিত বাণিজ্যিক দলিলাদি পর্যালোচনায় এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে আলোচ্য প্রতিষ্ঠানটি মূসক পরিহারের অভিপ্রায়েই মূসক দপ্তরে দাখিলকৃত দাখিলপত্রে প্রকৃত বিক্রয়/ক্রয় এবং উৎসে প্রদেয় মূসকের তথ্য গোপন করেছে।'

এ ছাড়া, কোম্পানি কর্তৃপক্ষ 'লিখিত জবাবের স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় প্রমাণক/দলিলাদি উপস্থাপনের জন্য একাধিকবার অনুরোধ জানিয়ে পত্র প্রেরণ করা হলেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রমাণক/দলিলাদি এ দপ্তরে প্রেরণ করেননি।'

পর্যালোচনা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অডিট কমিটি কোম্পানিগুলোর কাছে লিখিতভাবে অনুরোধ করলেও কোম্পানিগুলো অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ পুনরায় পরীক্ষা করার জন্য কোনো প্রতিনিধিকে মনোনীত করেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, 'তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য এ ধরনের একটি অতিরঞ্জিত ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য সন্নিবেশ করে রিপোর্টটি তৈরি করেছেন মর্মে দাবি করন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তারা সুস্পষ্টভাবে একটি ফৌজদারি অপরাধ করেছেন।'

এতে আরও বলা হয়, 'অপরদিকে, যে অডিট ফার্ম এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে, তারা পেশাগত অসততা প্রদর্শন করেছেন এবং প্রকারান্তে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটিকে একটি ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন।'

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, 'কাল্পনিক ও অসত্য' অডিট প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ঋণ মঞ্জুর করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকও 'খুবই অপেশাদার কাজ করেছে'।

'অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির এ দাবি মেনে নেওয়ার অর্থ হবে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া, যা সরকারের কোনো সংস্থা করতে পারে না।'

'আলোচ্য সিএ ফার্ম সম্পাদিত অডিট রিপোর্টটি মূল্য সংযোজন কর দপ্তর কর্তৃক সংগ্রহ করা হয়েছে আয়কর সার্কেল থেকে, যা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান সেখানে দাখিল করে। সংশ্লিষ্ট আয়কর সার্কেল এ অডিট রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর-দায়িতা নির্ধারণ করে তা নিষ্পত্তি করেছে। সেখানে কোনো ব্যাংক ঋণের সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই, ব্যাংক ঋণ গ্রহণের জন্য এ প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে—এ দাবিটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।'

এই তিন অর্থবছরের মধ্যে দুটি অর্থবছরে এস আলমের প্রতিষ্ঠান দুটির অডিট প্রতিবেদন তৈরি করেছে হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং।

অভিযোগের বিষয়ে লিখিত বিবৃতিতে অডিট ফার্মটি বলেছে, তারা 'কোম্পানির অডিটর, হিসাব প্রস্তুতকারী নয়'।

তাদের ভাষ্য, 'আমাদের কাজ ছিল প্রতিষ্ঠানটি যে হিসাব প্রস্তুত করেছে সেটি নোটসহ অডিট করা। আমরা অডিট পরিচালনা ও অডিট মতামতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অডিট মান অনুসরণ করেছি। কাজেই, কোনো বিষয়ে কাউকে সহযোগিতা করার প্রশ্নই ওঠে না।'

এসব ব্যাপারে এস আলম গ্রুপের কোম্পানি আইনজীবী মুস্তাফিজুর বলেন, 'ভ্যাট অডিটরদের আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল কারখানা পরিদর্শন করে বিক্রয় রেকর্ড দেখা এবং আমাদের কথা শোনার। কিন্তু তারা এসব কিছু না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এ কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে আমাদের কথা শোনা হয়নি। আমাদের কথা শুনলে তারা আরও পরিষ্কার হতে পারতো।'

তিনি স্বীকার করেছেন যে, ভ্যাট কর্তৃপক্ষ নয় মাসের দীর্ঘ অডিট ও পর্যালোচনার সময় তাদের সঙ্গে একাধিকবার লিখিতভাবে যোগাযোগ করেছে এবং তাদেরতে ব্যক্তিগত শুনানি ও লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় দিয়েছে।

'কিন্তু এটা যথেষ্ট ছিল না' দাবি করে তিনি বলেন, 'আমরা যতটা চেয়েছিলাম তারচেয়ে আমাদেরকে অনেক কম সময় দিয়েছে তারা। যে সময় দেওয়া হয়েছে সেটা ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে সব নথি এবং এত বড় ভ্যাট দাবির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া প্রস্তুত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না।'

অডিটকৃত আর্থিক বিবরণী এবং ভ্যাট রিটার্নে উপস্থাপিত বিক্রয় রেকর্ডের অসঙ্গতি সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের সিএ ফার্মের অডিটকৃত আর্থিক প্রতিবেদনে অগ্রিম বিক্রয়ও দেখানো হয়েছে।

তিনি বলেন, 'কিন্তু এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত কিছু বিক্রি আর হয়নি এবং যাদের পণ্য দেওয়া যায়নি, আমরা সেই ক্রেতাদের টাকা ফেরত দিয়েছি। এটা আমাদের অডিটকৃত আর্থিক প্রতিবেদনে উঠে আসেনি। তবে আমরা যে তাদেরকে টাকা ফেরত দিয়েছি, সেটা আমাদের ব্যাংক স্টেটমেন্টে আছে।'

কোম্পানি দুটি স্থানীয় বাজার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁচামাল কিনেছে এবং এই প্রক্রিয়ায় 'সংশ্লিষ্ট পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে'— ভ্যাট কর্তৃপক্ষের এই অনুসন্ধানের বিষয়ে তিনি বলেন, 'যেসব পণ্যের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায় না, কেবলমাত্র আমদানি করতে হয়। আর ভ্যাট কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনেই তো বলা হয়েছে যে তারা আমাদের আমদানির তথ্য সঠিক বলে মনে করছে। কাজেই, আমরা স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করেছি, এমন দাবি করা হয়েছে ধারণা থেকে।'

'অগ্রহণযোগ্য যুক্তি'

চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ এবং ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলছেন, তারা দুটি কোম্পানিকে 'শুনানির একাধিক সুযোগ' দিয়েছেন।

কোম্পানি দুটি ৬ জুন নতুন করে শুনানির জন্য আপিল করেছিল—এ বিষয়ে তিনি বলেন, তারা ইতোমধ্যে শুনানিতে উপস্থিত হয়েছে এবং অডিট চলাকালীন তাদের বক্তব্য জমা দিয়েছে।

মুশফিকুর রহমান বলেন, 'পরে, আমরা তাদের বক্তব্য পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছি। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদেরকে দুবার শুনানিতে হাজির হতে বলেছি, কিন্তু তারা আসেনি। তারপর যখন আমরা ভ্যাট দাবির আদেশ জারি করি, তখন শুনানির জন্য আরেকটি চিঠি পাঠায়—যা মেনে নেওয়া আর সম্ভব ছিল না। এই সব বিবরণ আমার আদেশে নথিভুক্ত রয়েছে।'

বিক্রির হিসাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিক্রির বিষয়ে তাদের নিজস্ব অডিটকৃত বার্ষিক প্রতিবেদনই চূড়ান্ত পরিসংখ্যান।'

গত ২৯ জুন তিনি বলেন, 'আমরা কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করিনি। তাদের অডিটকৃত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই তারা আয়কর পরিশোধ করেছে, কিন্তু ভ্যাট রিটার্নে তা দেখায়নি। যদি ক্রেতাদের কোনো টাকা ফেরত দেওয়াই হয়, তাহলে সেটা কীভাবে অডিট প্রতিবেদনে দেখানো হয় না? এটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য যুক্তি।'

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!