DMCA.com Protection Status
সাফল্যের ১১ বছর

ফেনীর একরামের খুনি আবিদ দুবাইয়ে সামলাচ্ছেন মতিউরের সাম্রাজ্য

জুলকারনাইন সায়ের: ছাগলকাণ্ডে সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তির তথ্য উঠে আসে। দেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি বিদেশেও মতিউরের সম্পদ রয়েছে। এবার জানা গেল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুবাইতে মতিউরের সম্পদ দেখভাল করেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামুল হক হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া অন্যতম প্রধান  আসামি। তার নাম আবিদুল ইসলাম ওরফে আবিদ। এই আবিদ আবার মতিউরের শ্যালক, অর্থাৎ দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মি আক্তার শিবুর ভাই। বাংলা আউটলুকের অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।

২০১৪ সালের ২০ মে প্রথমে গুলি করে এবং পরে কুপিয়ে ও গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার তৎকালীন চেয়ারম্যান একরামুল হককে। এই রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তখন দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি।

ঘটনার পর একমুলের ভাই রেজাউল হক জসীম বিএনপি নেতা মিনারকে আসামি করে অজ্ঞাত ৩০ থেকে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ফেনী থানায় হত্যা মামলা করেছিলেনন। প্রাথমিক অবস্থায় এই হত্যার ঘটনায় বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে দায়ী করা হলেও, পুলিশ ও র‌্যাবের যৌথ তদন্তে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীসহ আওয়ামী লীগের স্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসে।

একই বছর পুলিশ এই মামলায় ৫৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করে। তাদের মধ্যে ৫৫ জন আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ছিলেন।

একরাম হত্যার ঘটনায় অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন ফেনী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান লায়লা জেসমিন বড় মনির ছেলে আবিদুল ইসলাম ওরফে আবিদ। সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এমপি নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই। হত্যার ঘটনা তদন্ত করে পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, আবিদই প্রথমে একরাম চেয়ারম্যানকে লক্ষ্য করে গুলি চালান।

ফেনী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, আবিদের মা লায়লা জেসমিন বড় মনি। ছবি: সংগৃহীত
আবিদ ওই সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ২৪ মে একরামুল হত্যায় গ্রেপ্তার আবিদসহ আটজনকে উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সামনে আনা হয়। ওই সময় আবিদ সাংবাদিকদের বলেন, তিনি নিজে একরামকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছেন।

পরবর্তীতে একরামুল হত্যায় দ্বিতীয় মূল আসামি হিসেবে আবিদকে শনাক্ত করা হয় এবং আদালতেও তা দাখিল হয়। তা সত্বেও ২০১৭ সালে বিচারকার্য চলাকালেই আবিদের জামিন মঞ্জুর হয়। জামিনে বের হয়ে  ফেনী সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে দুবাই। এ কাজে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সহায়তা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৮ সালের ১৩ মার্চ একরামুল হত্যায় আবিদসহ ৩৯ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন ফেনীর জেলা ও দায়রা জজ। এই আদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা হাই কোর্টে আপিল করেছেন। এখনও শুনানির তারিখ আসেনি। আটকে রয়েছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) শুনানিও।

পুলিশ বলছে, ৩৯ ফাঁসির আসামির মধ্যে ১৬ আসামির হদিস জানে না সংস্থাটি। এই ১৬ আসামির একজনই হলেন আবিদ। প্রশ্ন হলো, ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম মূল আসামি, নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই আবিদ ফাঁসির আদেশ মাথায় নিয়ে কোথায় পালালেন?

এ প্রশ্নের উত্তর পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি, কারণ সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত-সমালোচিত এবং বিভিন্ন প্রশ্ন ও বেপরোয়া দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচন করা ছাগলকাণ্ডই খুনি আবিদকে সামনে নিয়ে আসে।

এনবিআর কর্মকর্তা মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মি আক্তার শিবুর ভাই এই আবিদ। সেই সূত্রে ছাগলকাণ্ডে জড়িত কিশোর মুশফিকুর রহমান ইফাতের মামা। ছাগলকাণ্ডের শুরুতে মতিউর ছেলে হিসেবে দ্বিতীয় সংসারের সন্তান ইফাতকে অস্বীকার করলে সংবাদমাধ্যমে নিজাম হাজারী জানান, ইফাত মতিউরেরই সন্তান এবং ইফাতের মা তার (নিজাম হাজারী) মামাতো বোন।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, আবিদ বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনেকটা রাজার হালে বসবাস করছেন। পুলিশ তাকে খুঁজে না পেলেও ছাগলকাণ্ডের পর ব্যাপক সমালোচনার শিকার ভাগ্নের পক্ষে সাফাই গেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল থেকে পোস্টও দিয়েছেন আবিদ। লিখেছেন- ‘মানুষের ভালো কাজ কেউ ভাইরাল করে না। ও (ইফাত) অনেক পুরস্কার পেয়েছে পাখি পালন করে, কই তখন তো কেউ তারে ভাইরাল করে নাই? এই ছেলের হাতের আইফোনটাও আমি দিছি। কারণ আমি তারে আদর করি। ওর দুটো আপন মামা আছে যাদের একজন দুবাই শত কোটি টাকার মালিক। তাদের ছেলে নেই বলে তার সব শখ তার মামা পূরণ করে। আর গাড়ি যে গুলোর ছবি দিছে সেগুলো একটা বিক্রি করে আরেকটা কিনছে। ওর মামাদের এত টাকা আছে যে, ও যে সমস্ত জিনিসগুলো ইউজ করে তা কিছুই না। এর চেয়ে বেশি ওর মামারা যাকাত দেয় মানুষকে। আর ওর বাবার যে ছবি দেওয়া হয়েছে সে তো তার বাবাই না।  বাবার সাথে তাদের সম্পর্ক নেই ৩ বছর হয়ে গেছে। তাই না বুঝে কারো ক্ষতি না করাই  ভালো। ইফাতের আরেক মামা আছে আমেরিকায় তিনিও শিল্পপতি। ছাগলটি ওর মামার জন্যই কিনেছে। অনুসন্ধান যদি করতে হয় তাইলে আমেরিকা আর দুবাই আইসা করেন তার মামাদের। তাইলে বুঝতে পারবেন। তাই অনুরোধ করবো আমার সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের এটা শেয়ার থেকে বিরত থাকবেন।’ (বানান ও যতিচিহ্ন সম্পাদিত)।

পোস্টে বলা ওই শত কোটি টাকার মালিক মামাদের বিষয়ে খোঁজ করতে গিয়েই মূলত বাংলা আউটলুক জানতে পারে, ইফাতের এই মামাদের একজন হলেন একরামুল হত্যার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আবিদুল ইসলাম আবিদ। তার বাবার নাম ফখরুল ইসলাম বাবর। আরেক মামার নাম নাসের উদ্দিন সোহাগ।

মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মি আক্তারের পারিবারিক সূত্র এবং অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত এই দুই ব্যক্তিই এনবিআরের সদ্য সাবেক কর্মকর্তা মতিউরের দুবাইতে থাকা অবৈধ সম্পদের দেখভালকারী (কেয়ারটেকার)। আবিদ-সোহাগের দুবাইয়ের বিপুল অর্থের মূল মালিক হলেন মতিউর। আর সেগুলো দেখাশোনা করেন দুই শ্যালক আবিদ-সোহাগ।  

ফেসবুকে আবিদুলের আইডি একটু ঘাটলেই দুবাইতে তার রাজকীয় জীবনযাপনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এই ব্যাপারে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সূত্র দাবি করেছে, ফেনী এলাকার মাদক কারবারের অন্যতম নিয়ন্ত্রকও এই আবিদ। দুবাইতে বসেই লোকজন দিয়ে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। তার চালচলনে রয়েছে বেশ ফিল্মী ভাব।

কিছুদিন আগেই ফেসবুকে আবিদ লিখেছেন, ‘যেকোনো জায়গায়কে আমি আমার মতো ফেনীতে রূপান্তরিত করতে ভালোই পারদর্শী, আলহামদুলিল্লাহ সকল সম্মানের জন্য।’

আদরের ভাগিনাকে নিয়ে নানা সময় ফেসবুকে পোস্টও দেন আবিদ। ছবি: সংগৃহীত
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি নয়, নিজেকে তিনি হিরো মনে করেন! আবিদের বিষয়ে জানতে ফেনীর সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘নিজাম হাজারীই যেন ফেনীর সরকার-নিজ গাড়িতে চিহ্নিত সন্ত্রাসী নিয়ে বিচরণ, জেলে ঢুকে অপরাধীদের নিয়ে সভা করা, অবৈধ অস্ত্র বহনসহ এহেন কোনো অপকর্ম নাই যা তিনি করেন না। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হতে শুরু করে সবাই তার কাছে এক প্রকারের জিম্মি, নিজাম হাজারীর সাজাপ্রাপ্ত মামাতো ভাইকে খুঁজতে সাহস করবে কে?’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘নিজাম সাহেব যখনই দুবাই ভ্রমণ করেন, তখনই আবিদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আর এসবই তারা জানেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়েও এ বিষয়ে অবগত।’ বাকিটা তিনি এই প্রতিবেদককে বুঝে নিতে পরামর্শ দেন।

তবে এসব বিষয়ে নিজাম হাজারীর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

দুবাই পুলিশ কী বলে

বাংলাদেশে বহুল আলোচিত একটি হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি দুবাইতে মুক্তভাবে জীবনযাপন করছে, এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুবাই পুলিশের সিআইডি শাখার কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ বিন রাশেদ আল খামিস বলেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আবিদুল ইসলামের বিষয়ে কোনো অনুরোধ তারা পাননি। এমনকি ইন্টারপোলেও এই পলাতক অপরাধীর বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে লুকিয়ে থাকা সেসকল দেশের অপরাধীদের যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে স্ব স্ব দেশে প্রেরণ করতে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশেষভাবে আগ্রহী। এই নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সহায়তা চাইলে এর কোনো ব্যত্যয় হবে না। 

আবিদের পলাতক থাকার ব্যাপারে ফেনীর পুলিশ সুপার (এসপি) জাকির হাসান বলেন, ‘বিভিন্ন সময় জানতে পারি, পলাতক আসামিরা বাইরে অবস্থান করছে। তবে কে কোথায় আছে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য না পাওয়ায় আমরা আমাদের নিজস্ব মেকানিজমে সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছর মৃত্যুবার্ষিকীর সময় এ কথাগুলো ওঠে, কিন্তু আমরা কংক্রিট তথ্য ছাড়া কিছু বলতে পারি না।’

আবিদ নিজেই গুলি করেন

ফেনীতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবিদ নিজে ইকরামুল হক গুলি করেন এবং হাতে থাকা ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেন। ২০১৪ সালের ২৪ মে উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে আবিদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সেদিন (হত্যাকাণ্ডের দিন) সকালেই তারা ঘটনাস্থলের আশপাশে জড়ো হয়েছিলেন। সকাল ৮টার দিকে শিফাত, শানান, সানি, রাহাত, মোহন, অনিক ও সৈকত তার কাছে আসেন। রুটি সোহেল নামে আমাদের এলাকার এক বড় ভাই তিনটা পিস্তল নিয়ে আসে। আমাকে আর শানানকে দুটা দিয়ে নিজে একটা রাখে। রুটি সোহেল আমাকে বলে, কেউ সামনে এলে গুলি চালাবি।

হামলার বর্ণনা দিয়ে আবিদ বলেন, সকাল ১১টার দিকে একাডেমির সামনে একরামের গাড়ি আসে। আমি, মানিক, রুটি সোহেলসহ কয়েকজন একটা ইজিবাইক নিয়ে সে গাড়ির গতিরোধ করি। সেখানে থাকা অন্তত ৪০/৫০ জন গাড়িতে ইট ছুড়তে থাকে, রামদা দিয়ে গাড়িতে কোপাতে থাকে। আমি ও শানান ওপরের দিকে গুলি ছুড়ি। রুটি সোহেল গাড়ির ভেতরে গুলি চালায়। পাপন, নয়ন ও তাদের কয়েক বন্ধু পাশের একটা দোকান থেকে কেরসিন এনে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

ফেনী ও ঢাকার অনেকের যোগাযোগ

আবিদের ফেসুবক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, ফেনী থেকে নিয়মিতই বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন তার সাথে যোগাযোগ করছে। তার পোস্টে কমেন্ট করছে। তাকে ট্যাগ করে পোস্ট দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেকেই দুবাই গেলে তার সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে। কাউকে আবার বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে করে রিসিভ করছেন।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!