ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন সব সময়ই ছিলেন আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে। অভিযোগ ছিল, দুর্নীতি, তদবির, পদ বাণিজ্যসহ নানাভাবে অর্থ কামিয়ে বিদেশে পাচার করে তিনি দেশ ছেড়েছেন। এদিকে সম্প্রতি লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝরের বিরুদ্ধে মানহানি মামলায় হেরে যাওয়ার পর আশরাফুল আলম খোকনকে ১ লাখ ৫৪ হাজার পাউন্ড জরিমানা করেন রয়েল কোর্ট অব জাস্টিসের কিংস বেঞ্চ।
এবার আশরাফুল আলম খোকনের বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) গোপন প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করেছেন আলজাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। সেখানে হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকনের নামে বিপুল সম্পদ, দুর্নীতি, তদবির, পদ বাণিজ্যসহ অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিজিএফআইয়ের গোপন প্রতিবেদনে খোকনের সম্পদের বিষয়ে বলা হয়,
১। প্রায় ৪২ কোটি ৮১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৩ টাকার সম্পদের (বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি, যুক্তরাষ্ট্রে কমার্সিয়াল ফ্লোর, ইটভাটা, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি) মালিক।
২। গাজীপুরের বাড়ির মূল্য প্রায় ৩ কোটি হলেও তিনি ট্যাক্স ফাইলে ১১.২৫,০০০.০০ (এগারো লক্ষ পঁচিশ হাজার) বলে উল্লেখ করেন।
৩। তার সর্বশেষ (২০১৮-১৯) ট্যাক্স ফাইলে মোট সম্পদের পরিমাণ এক কোটি পঁচিশ লক্ষ দশ হাজার পাঁচশত বিশ টাকা উল্লেখ করলেও তার আনুমানিক মোট সম্পদের পরিমাণ ৪২ কোটি ৮১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৭৩ টাকা।
৪। তিনি অধিকাংশ সম্পদ বেনামে ক্রয় করেছেন। তার দুটি জিপ ও একটি কার আছে, যার সবগুলোই অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
৫। সোনালী ব্যাংকের স্যালারি অ্যাকাউন্ট হতে তিনি গত এক বছরে কোনো টাকা উত্তোলন করেননি এবং তার পূর্বের বছর মাত্র দুই ধাপে ১,৪০,০০০ টাকা উত্তোলন করেছেন।
ডিজিএফআইয়ের গোপন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের আপত্তির সত্ত্বেও সিরাজগঞ্জের জামায়াত পরিবারের সদস্য রফিকুল ইসলাম রনিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটির সহ-সম্পাদক পদ পাইয়ে দেন আশরাফুল আলম খোকন।
ব্রাঞ্চের রিপোর্ট পজিটিভ করায় সহযোগিতা করতেন হাসিনার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন। ডিজিএফআইয়ের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএমবিটে কর্মরত জামায়াত-বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের রাজনৈতিক কারণে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ক্লিয়ারেন্স/রিপোর্ট নেগেটিভ হলে তিনি ফোন করে এসবি কর্মকর্তাদের তা পজেটিভ করে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন বলে জানা যায়।
প্রতিবেদনে তার অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বলা হয়:
২০১৭-২০১৮ সালে আইসিটি বিভাগের অধীনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর প্রদান প্রকল্পে তিনি বড় ধরনের অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন বলে জানা যায়। খোকন তার বন্ধু তারেক শমী (সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপির মেয়ের জামাই) ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ না করে নগদ ডলারে পরিশোধ করেছেন বলে জানা যায়। এ খাত থেকে তারা দুজন প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা অবৈধভাবে গ্রহণ করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
এছাড়া ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস "নগদ" এর পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েব টেকনোলজিস লিমিটেডের নিকট থেকে তিনি কয়েকজন মিলে ১২ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে জানা যায়। তিনি বেনামে নিজে অথবা পরিচিত ব্যক্তি যাদের নিকট হতে পরবর্তীতে আর্থিক সুবিধা নেওয়া যাবে তাদের বিভিন্ন এলাকায় নগদের ডিলার/এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছেন। কথোপকথন সে কেরানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ ও মানিকগঞ্জের রনিকে 'নগদ' এর ডিলারশিপ প্রদান করছে। এমনকি টাকা প্রদান না করেও উক্ত ব্যবসার পার্টনার হচ্ছেন যা তার ২০১৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর মোবাইল কথোপকথন হতে পাওয়া যায়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগে তিনি নিয়মিতভাবে তদবির করতেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তাজউদ্দিনের পরিবারকে কোণঠাসা করে কাপাসিয়া হতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন।
ম্যাক্স গ্রুপ হতে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ:
খোকন আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ম্যাক্স গ্রুপ বলে জানা যায়। তিনি ম্যাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয় রাওয়া কমপ্লেক্স মহাখালীতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা:
তারানা হালিম ডাক ও টেলি-যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন তার পিএস জয়দেব নন্দীর সাথে খোতনের সখ্যতা গড়ে উঠে। তিনি জয়দেবের মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
এছাড়া ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে শিল্পী নিয়ে এসে তাদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করতেন আশরাফুল আলম খোকন। প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি কৌশিক হাসান তাপসের গান বাংলা টিভি চ্যানেলের নাম করে ইউক্রেন হতে নারী নিয়ে এসে বিভিন্ন সরকারি-সরকারি, আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রেরণ করে করতেন বলে জানা যায়। এদের বিনা পারিশ্রমিকে (ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য) অনুষ্ঠান করার কথা বলে এ দেশে নিয়ে আসা হয় এবং ইমিগ্রেশন পুলিশ দুই বার এ ধরনের ইউক্রেনীয় নাগরিকদের হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আটকে দিলে বিষয়ব্যক্তি ফোন করে তাদের ইমিগ্রেশন করিয়ে দেন বলে জানা যায়।
ব্যয়বহুল ইফতার পার্টি আয়োজন:
আশরাফুল আলম খোকন প্রতিবছর রমজান মাসে সেহেরী পার্টি করত , যেখানে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ করেন বলে জানা যায়।
এর বাইরে অধিকাংশ বেসরকারি টিভি স্টেশন হতে আর্থিক সুবিধা নিতেন বলে অভিযোগ ছিল। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠানে কোনো সাংবাদিক প্রশ্ন করার সুযোগ পাবেন তা তিনি আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে ঠিক করে দেন বলে জানা যায়। এছাড়া কর্মস্থলে সহকর্মীদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করতেন বলে জানা গেছে।
তদবির বাণিজ্য:
খোকনের মোবাইল কল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, তার অধিকাংশ কল বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ, প্রমোশন, বদলি ও বিভিন্ন তদবির সংক্রান্ত এবং এক্ষেত্রে পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি (মো: ইসরাইল হাওলাদার, ০৪.০৮.২০১৯ তারিখের কথোপকথন), পুলিশ সুপার, উপসচিব (ডিসি হতে ইচ্ছুক- ০৪.০৮.২০১৯ তারিখের কথোপকথন)), ইউএনও (সৈয়দ ফয়েজুল ইসলাম টাংগাইলের নাগরপুর হতে ঢাকার ধামরাইতে বদলি), ব্যাংকের এসপিও, খাদ্য কর্মকর্তা প্রভৃতি পদের ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বা মেসেজ লেনদেন হচ্ছে।