ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মধ্য আগস্টে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ঢাকাস্থ ফ্রান্সে দূতাবাসে আত্মগোপন করেছেন। ততদিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ট সহযোগী সালমান এফ রহমান এবং আনিসুল হকের মতো লোকরা অপমানজনক পরিস্থিতি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
চলতি বছরের শুরুর দিকে বিরোধীদের বয়কট নির্বাচনে জয়ী হয়ে হাসিনার চতুর্থবার শাসনামলে আরাফাত পরিচিত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে তার বাকপটুতা এবং সাহসিকতার জন্য। আরাফাত একাডেমিক ব্যক্তির মতো করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তথ্য দিয়ে থাকতেন। যদিও কেউ কেউ তার বক্তব্য নির্ভুল মনে করতেন। তবে বাকিরা মনে করতেন তার বক্তব্য বিভ্রান্তিকর। যদিও এই নির্ভুল ও বিভ্রান্তিকর ইস্যুতে বিতর্ক রয়েই গেল।
তবে এটা খুব পরিষ্কার যে জুলাই বিপ্লবের সময় তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আরাফাত উল্লেখযোগ্য মনোযোগ কেড়ে ছিলেন। সে সময় তিনি আল জাজিরার মতো বড় বড় সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এমনকি সেই সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাসিনার বহুল প্রচারিত বৈঠকের মূল মঞ্চেও জায়গা করে নিয়েছিলেন।
ওই বৈঠকে তিনি বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আন্দোলনকারী কিছু ছাত্রকে মাদক সেবন করানো হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া তিনি বার বার দাবি করেছিলেন, পুরো আন্দোলনটি জামায়াত-শিবিরের কাজ। আর তার এই ধরনের কথাবার্তা শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তাই যখন ফ্রান্সের দূতাবাসে আরাফাত আশ্রয় চাওয়ান খবর ছড়িয়ে পড়ে তখন ছাত্রদের কয়েটি দল ফ্রান্স দূতাবাসের পাশেও বিক্ষোভের বিবেচনা করেছিল। ফ্রান্স দূতাবাসের লাগোয়াই জার্মানির দূতাবাস।
পরবর্তীতে ছাত্ররা বুঝতে পারে তাদের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে তারা এও বুঝতে পারে তাদের অসন্তোষের বিষয়টি জানানো দরকার।
মাসদুপুইয়ের সঙ্গে আরাফাত। ছবি: সংগৃহীত
এই খবর নিয়ে অবশ্য ফ্রান্সের দূতাবাস থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক বিবৃতিতে দূতাবাস আরাফাতকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে। তা সত্ত্বেও, ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুইয়ের বাসভবনে আরাফাত লুকিয়ে আছেন বলে নতুনভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে।
আরাফাতের ফরাসি কানেকশন
এই দাবিটি যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের বাসভবন দখলের ইচ্ছাও শেষ পর্যন্ত হাওয়া হয়ে যায়।
আরাফাত গ্রেপ্তার হননি। যদিও সংবাদমাধ্যমে বহুল প্রচারিত সংবাদ ভিন্ন কথা বলছে। আরাফাতের অবস্থান কোথায় তা নিয়ে আমার আগ্রহ তেমন একটা ছিল না, বরং ঢাকায় এতো দূতাবাস থাকতে আরাফাতের লুকানোর স্থানের সঙ্গে ফরাসি দূতাবাসের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়টাতে বেশি আগ্রহী ছিলাম।
এর পেছনে কারণ আছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁখোর বহুল প্রচারিত বাংলাদেশ সফরে আরাফাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের তীব্র চাপের মুখে থাকা হাসিনা সরকারের জন্য ফরাসি প্রেসিডেন্টের এই সফরটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি দেশের নেতার ওই সফর নিঃসন্দেহে হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের জন্য একটি অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিল। যা হাসিনা সরকারকে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
সাবধানে মঞ্চস্থ ম্যাখোঁর সফরের দৃশ্যের আড়ালে আরও বিশেষ কিছু ছিল। যেমন, নৌকা ভ্রমণ, ফোক গায়কের সংগীতের আসরে উপস্থিতি, পুরান ঢাকায় রিকশা ভ্রমণ এবং উদ্বেগ দূর করা হাসিনার সঙ্গে উষ্ণ আলিঙ্গনের আড়ালে বিলিয়ন ডলারের এয়ারবাস কেনার চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। চুক্তিটি উভয় সরকারের জন্য সুবিধাজনক ছিল।
কিন্তু আমি কীভাবে নিশ্চিত হতে পেরেছিলাম যে, আরাফাতই ম্যাখোঁর সফরের পেছনে মূল ক্রীড়ানক ছিলেন? কারণ, আমি এটা আরাফাতের মুখ থেকেই সরাসরি শুনেছিলাম।
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে আমি এক ফরাসি সাংবাদিকের সঙ্গে কাজ করছিলাম এবং আমরা আরাফাতের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে আরাফাত কিছুটা গর্বের সঙ্গে দাবি করেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ম্যাখোর বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্তত দু'জনের সঙ্গে আরাফাতের করা এই দাবিটি আমি যাচাই করেছিলাম। এছাড়া ফরাসি ওই সাংবাদিকও আরাফাতের বক্তব্য সত্য বলে জানান।
আমার নিবন্ধের মনোযোগ আসলে আরাফাত, ম্যাঁখো, ওই সফর বা বিতর্কিত এয়ারবাস চুক্তি নয়। বরং আমার মনোযোগ সম্পূর্ণ অন্য কিছুর ব্যাপারে। জে-জেডকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, ‘আমার সম্পর্কে কী বলা হয়েছিল তা আমাকে বলবেন না। আপনাকে এটি বলতে কেন তারা এত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছিল তা আমাকে বলুন।’
আরাফাত এবং হাসিনার অন্য সহযোগীরা কি করতে পারে তাও আমাকে আগ্রহী করে না। কিন্তু ফ্রান্সের মতো দেশের দূতাবাসগুলি কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে ‘ফরাসি দূতাবাসে আরাফাত লুকিয়ে আছে’র মতো গুজব সামাজিক মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য মনোযোগ লাভ করে।
আমি বিশ্বাস করি প্রাণবন্ত হাসি আর ধূসর সাদা চুলের ফরাসি রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুইয়ে ঢাকার ফরাসি দূতাবাসের ‘কলঙ্কিত’ এ খ্যাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায় আছে।
‘সম্যাযুক্ত’ ফরাসি রাষ্ট্রদূত’
অভিজ্ঞ কূটনীতিক মাসদুপুইয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে ঢাকায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নেন। তিনি ফরাসি ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে বিভিন্ন ভূমিকা এবং কুয়েত, রাশিয়া, আফগানিস্তান এবং মিশরে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকায় আসার পর থেকে ফরাসি এ রাষ্ট্রদূত হাসিনার প্রকাশ্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে মিশে যান।
স্বশরীরে উপস্থিত থেকে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধমে লেখা—উভয় ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতি তার সমর্থন ও পক্ষাবলম্বন অনেকের কাছে স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি সমর্থন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
ঢাকায় তার যোগ দেওয়ার পরপরই, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় নিবেদিত ৫১টি দেশের একটি প্ল্যাটফর্ম মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশনের (এমএফসি) বাংলাদেশ অংশ একটি বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে হাসিনা সরকার দৈনিক দিনকাল পত্রিকার প্রকাশনার অনুমোদন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এমএফসি সদস্যভুক্ত বেশির অধিকাংশ বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করলেও বেশিরভাগ প্রধান MFC সদস্য দেশ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেও, মাসদুপুইয়ের অধীনে ফ্রান্স তা করেনি।
পরবর্তীতে আমিসহ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে এক বৈঠকে মাসদুপুই আকস্মিকভাবে দৈনিক দিনকালকে সংবাদপত্র নয় অন্য কিছু বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেসময় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তিনি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে তার সুনাম নষ্ট করতে চাননি।
সুচারুভাবে সজ্জিত তার ঢাকা অ্যাপার্টমেন্টে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তাকে খুব স্বাভাবিক ও প্রাণবন্ত আচরণ করতে দেখা যায়। তিনি আমাদেরকে কফি এবং বাটার বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ান করেছিলেন। আমাদের প্রায় ঘণ্টাব্যাপী কথোপকথনে তিনি আকস্মিকভাবে দুবার ধূমপান করেছিলেন, ফরাসিরা যেমনটায় অভ্যস্ত। তাতে আমরা অনুমান করেছিলাম এর মাধ্যমে তিনি গুরুতর বিষয়ের ব্যাপারে শান্তশিষ্ট মনোভাব দেখানোর চেষ্টা করছিলেন।
সম্ভবত মানানসই নয় এমন দৃষ্টিভঙ্গিতে মাসদুপুইয়ে গুরুতর সমস্যাগুলি মোকাবিলা করছিলেন। তার দূতাবাসের কূটনৈতিক কর্মসূচিগুলোতে তিনি বারবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় থাকা আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। ঢাকাস্থ পশ্চিমা অন্য দূতাবাসগুলি যা করেনি।
অন্যান্য দূতাবাসের বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা তার খুব একটা প্রশংসা করেননি। তারা হাসিনা সরকারের প্রতি তার অবস্থানকে ‘সমস্যাপূর্ণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এক কূটনীতিক তো স্পষ্টভাবে বললেনেই, তিনি [মাসদুপুয়] স্বৈরাচারের জন্য একজন চিয়ারলিডার ছিলেন।
যদিও মাসদুপুই বাংলাদেশের সাথে তার দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যতটুকু ভূমিকার দরকার ছিল তা বজায় রেখেছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তিনি তার কার্যক্রম চালিয়েছেন।
লোক সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দের সঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাঁখো। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা ট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ১১ জুলাই, যে বিপ্লবে শেষমেষ হাসিনার পতন হয় তার মাত্র পাঁচ দিন আগে মাসদুপুই ফরাসি জাতীয় দিবস উদযাপনের সময় বলেছিলেন, অনেক বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিক মনে করতে চান যে এটি সম্পূর্ণরূপে বাণিজ্যিক কারণে এবং তথাকথিত এয়ারবাস চুক্তি এবং অন্যান্য বাণিজ্য দৃষ্টিকোণ উল্লেখ করতে আগ্রহী। অবশ্যই তারা ভুল এবং আমাদের প্রতিযোগীদের প্রভাবে পক্ষপাতদুষ্ট।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে ফ্রান্স সম্পর্ক জোরদার করতে চায় যে, দেশটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হাসিনার পতন এবং পালিয়ে যাওয়ার পর, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাসদুপুইকে এখন দেখা করতে দেখা যায়। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে যাকে পছন্দ তার সঙ্গেই বসতে পারার সক্ষমতা বা নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করার সুবিধাটুকু তার আছে।
যাইহোক, বাংলাদেশের সঙ্গে ফ্রান্সের দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। দেশটির স্বীকার করতে হবে যে তাদের রাষ্ট্রদূতের নাইট অব দ্য ন্যাশনাল অর্ডার অব মেরিট এবং নাইট অব দ্য লিজিয়ন অব অনারের মতো মর্যাদাপূর্ণ সম্মান থাকা সত্ত্বেও, এখানে কলঙ্কিত উত্তরাধিকার রেখে গেছেন।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রচারে নিজেদের গর্বিত ভাবা একটি জাতির জন্য এটি খুব একটা স্বস্তিদায়ক চিত্র নয়।