বাংলাদেশের বড় শহরগুলো, বিশেষ করে ঢাকা, দীর্ঘদিন ধরেই তীব্র যানজট সমস্যার সম্মুখীন। এই সমস্যার অনেক কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ হলো বাস ড্রাইভারদের আচরণ। তারা প্রায়ই রাস্তায় যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করান, যা অপ্রয়োজনীয় যানজট তৈরি করে। বহুবার সতর্কতা এবং আইন প্রয়োগের চেষ্টা করা হলেও এই অভ্যাস পরিবর্তন হয়নি এবং এর ফলে রাস্তার শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এখন সময় এসেছে আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুনভাবে চিন্তা করার এবং এর একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে বাস ড্রাইভারদের সরকারি চাকরির আওতায় নিয়ে আসা।
বর্তমান পরিস্থিতি : বাংলাদেশের অধিকাংশ বাস সেবা বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত, যেখানে ড্রাইভারদের কর্মকাণ্ডের ওপর তেমন কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। অধিকাংশ বাস ড্রাইভারই কম বেতন পান এবং তাদের কাজের চাপ থাকে অত্যধিক। এ ছাড়া, তাদের কাছে এমন কোনো প্রণোদনা নেই, যা তাদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করবে। ফলে তারা যেখানে সেখানে থেমে যাত্রী তোলেন, অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন এবং লেন ব্লক করে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটান। এর ফলে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এবং জনগণ প্রতিদিনের যাতায়াতে ভোগান্তির শিকার হন।
সরকারি বাস ড্রাইভার ব্যবস্থা : যদি বাস ড্রাইভারদের সরকারি চাকরি হিসেবে নিয়োগ করা হয়, তাহলে এই পরিস্থিতির অনেকটা পরিবর্তন হতে পারে। একটি সরকার-নিয়ন্ত্রিত গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু হলে ড্রাইভাররা কাজের নিরাপত্তা, একটি স্থিতিশীল বেতন এবং পরিবারের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ও পেনশনের মতো সুবিধা পাবেন। এই ধরনের সুবিধা তাদের আরও দায়িত্বশীল এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মী হিসেবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে, কারণ কোনো নিয়ম ভাঙলে তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি থাকবে।
সরকারি চাকরি হিসেবে বাস ড্রাইভারদের নিয়োগ দিলে তাদের জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। কঠোর নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেখানে ট্রাফিক আইন ভাঙলে শাস্তি, সাময়িক বরখাস্ত বা চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণের ব্যবস্থা থাকবে। এ ধরনের তত্ত্বাবধান ড্রাইভারদের আইন মানতে বাধ্য করবে, কারণ তাদের চাকরির নিরাপত্তা তাদের কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ : এই মডেল অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশে সফলভাবে কাজ করেছে। যেমনÑ সিঙ্গাপুর এবং জাপানে গণপরিবহন ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং ড্রাইভাররা হয় সরকারি কর্মী, অথবা কঠোর সরকারি চুক্তির আওতায় কাজ করেন। এই ড্রাইভাররা কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যান, নির্দিষ্ট রুট এবং স্টপ মেনে চলেন এবং উচ্চমানের দায়িত্ব পালন করেন। এর ফলে এই দেশগুলোর গণপরিবহন ব্যবস্থা দক্ষতা এবং শৃঙ্খলার জন্য পরিচিত।
জার্মানিতেও এই মডেল কাজ করে, যেখানে অনেক বাস ড্রাইভার সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে কাজ করেন, চাকরির নিরাপত্তা এবং বিভিন্ন সুবিধা উপভোগ করেন। কঠোর নিয়ম-কানুন ও প্রণোদনার মিশ্রণ একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পেশাদার কর্মী গোষ্ঠী তৈরি করে, যা যানবাহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক হয়।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য প্রভাব
১. যান চলাচল স্বাভাবিক হবে : একটি সরকার-পরিচালিত ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে যে বাস ড্রাইভাররা শুধুমাত্র নির্ধারিত বাস স্টপগুলোতেই থামবে, যার ফলে যানজট হ্রাস পাবে এবং যান চলাচল সহজ হবে।
২. সড়ক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে : ভালো প্রশিক্ষণ, উচ্চ মানের চাকরির শর্তাবলি এবং নিয়ম ভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তির ফলে বাস ড্রাইভাররা সড়ক নিরাপত্তার প্রতি আরও সচেতন হবেন। এতে বাস সংক্রান্ত দুর্ঘটনার সংখ্যা কমবে এবং সড়ক নিরাপদ হবে।
৩. ড্রাইভারদের কর্মপরিবেশ উন্নত হবে : স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন এবং চাকরির নিরাপত্তার মতো সুবিধা প্রদান করা হলে, আরও যোগ্য এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এই পেশায় আসবেন। সন্তুষ্ট এবং সুরক্ষিত ড্রাইভাররা নিয়ম মেনে চলার প্রতি আরও আগ্রহী হবেন, যা পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও কার্যকরী করবে।
৪. জনগণের আস্থা বৃদ্ধি : একটি সুসংগঠিত সরকার-পরিচালিত বাস সেবা জনগণের আস্থা অর্জন করবে, যা আরও মানুষকে গণপরিবহন ব্যবহার করতে উৎসাহিত করবে। এর ফলে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা কমে যাবে এবং যানজট আরও হ্রাস পাবে।
বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ : নিঃসন্দেহে, সরকারি বাস ব্যবস্থায় রূপান্তর করা চ্যালেঞ্জিং হবে। ড্রাইভার নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারের বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। বর্তমানে বাজারে প্রভাবশালী বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলোও এই পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে। তবে, একটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এই রূপান্তর সম্ভব হতে পারে।
এছাড়াও, সিস্টেমটি যেন স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত থাকে তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পরিষ্কার নিয়ম, নিয়মিত মূল্যায়ন এবং কার্যকরী তত্ত্বাবধান এই উদ্যোগকে সফল করতে সহায়ক হবে।
ভবিষ্যতের পথে একটি পদক্ষেপ : বাংলাদেশের যানজট পরিস্থিতি রাতারাতি উন্নত হবে না, তবে বাস ড্রাইভারদের সরকারি চাকরি দেওয়া যানজট সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণকে মোকাবেলা করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। ড্রাইভারদের চাকরির নিরাপত্তা এবং প্রণোদনা প্রদান এবং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে, আমরা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং কার্যকরী গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি। শেষ পর্যন্ত যানজট ব্যবস্থাপনা শুধু সড়কের সমস্যা নয়; এটি মানুষ এবং তাদের ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। বাস ড্রাইভারদের মূল্যায়ন এবং তাদের ওপর সঠিক দায়িত্ব অর্পণ করে, আমরা আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে আমাদের শহরগুলোকে আরও সুসংগঠিত, কার্যকরী এবং সবার জন্য নিরাপদ করে তুলতে পারি।
লেখক- আহমেদ আফ্রিদি বিন ফেরদৌস : এক্সিকিউটিভ মার্চেন্ডাইসিং, লোটো স্যু, ঢাকা