ক্যাপ্টেন (অবঃ) মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গতকাল রবিবার তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কাজটির গুরুত্ব অনুসারে অনায়াসে বলা যায় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কাজটিই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেয়।
রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে দেশের টাকা পাচার যে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে তা নিয়ে প্রায় সকলেই অবগত। আর হাসিনাশাহী এই প্রক্রিয়াকে বছরের পর টিকিয়ে রেখেছিল। শ্বেতপত্রের হিসেবে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়েছে। অর্থাৎ, যেই পদ্মা সেতু বানিয়ে আওয়ামী লীগ বছরের পর বছর অহংকার করতো, তাদের লুটেরারা প্রতিবছর এর চার গুণের বেশি টাকা লুট করেছে। আরও সহজ করে বললে, আওয়ামী লুটেরারা যেই টাকা লুট করেছে তা দিয়ে অন্তত ৬০টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত।
এর জের আমাদের বহু বছর ধরে টানতে হবে। লুটেরারা দেশের ব্যাংকগুলো খালি করে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, আওয়ামী আমলে এগুলোর সঠিক তথ্যও পাওয়া যেত না। এই গুরুত্বপূর্ণ শ্বেতপত্রটি সেই কাজটি করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এখন যা সাড়ে ১২ শতাংশ। আগামী মাসে তা ১৫ শতাংশ, এরপর ১৭ শতাংশ হয়ে ধীরে ধীরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। এই খেলাপি আগেই হয়ে আছে। এখন হিসাবে তা আসবে। এটা কমিয়ে আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, সামনে খেলাপি ঋণ যেটা দাঁড়াবে তার অর্ধেক বা আড়াই লাখ কোটি টাকা হবে এস আলম, সাইফুজ্জামানসহ (সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী) বড় কয়েকটি গ্রুপ ও ব্যবসায়ীর। ২০১৭ সালের পরে এসব ঋণ নেওয়া হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পাচার করা হয়।
এনপিএল বা খেলাপি ঋণের হিসাবটা সাজানো ছিল, ফলে তা অর্থনীতির স্বাস্থ্য নিয়ে ভুল বার্তা দিতো এবং অনেক দুর্বল ব্যাংককেও সবল হিসেবে দেখাতো যা দেশের মানুষকে প্রতারিত করেছে। সুখবর হলো, প্রকৃত তথ্য আসছে। এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়বে, কমবে উইন্ডো ড্রেসিং এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া অন্যান্য স্ট্রেসড এসেটের পরিমাণ। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, নিরপেক্ষতা ও সুশাসনের জন্য বিদেশি নিরীক্ষক আনা জরুরি হলেও, অনেক সময় দেশের অভ্যন্তরীণ নানা হিসাব নিকাশ, ব্যক্তি বা তথ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকায়, শুধু কাগজপত্র দেখে তাদের পক্ষে সকল ঋণখেলাপি চিহ্নিত করা সম্ভব নাও হতে পারে। এই নিরীক্ষকদের সাথে সরকারি ও বেসরকারি সৎ ও দক্ষ অডিটরদের একটি ছোট ও চৌকস দলকে সম্পৃক্ত করা গেলে, বিস্তৃত আকারে তথ্য উঠে আসা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে, তবে তথ্য উঠে আসাই শেষ কথা নয়।
আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষার জন্য, কেবল টাকা ছাপিয়ে যাওয়া কোন দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। প্রয়োজন এইসব খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ। সে জন্যে সবার আগে কার্যকর ও গতিশীল করতে হবে বিচার ব্যবস্থাকে, বিদ্যমান আইনের মাধ্যমেই শুধু মামলা সমাধানের অচলাবস্থার অবসান ঘটালেই প্রচুর পরিমাণে অর্থ আদায় সম্ভব হবে।
এছাড়াও, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিপক্ষে করণীয় কিছু কার্যক্রমের কথা বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ একটি সার্কুলারের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। একটা সঠিক তালিকা তৈরি করে ঐ সার্কুলার অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ বা আরো কঠিন ব্যবস্থা (পরিবারের সকলের বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা বা সকল সরকারি সার্ভিস প্রাপ্তিতে আলাদা ট্রিটমেন্ট) নেয়া হলে, অনেক ঋণখেলাপিই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করবেন বলে আশা করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক দায়িত্ব আছে। তবে নির্বাচিত সরকার না হওয়ায় সব কাজ করা সম্ভব না। ফলে, নির্বাচন আয়োজন ছাড়া অন্যান্য জরুরি এবং সরকারের সাধ্যে থাকা কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের ঘুণে ধরা অর্থনীতির ঠিক কি অবস্থা তা জানাটা অর্থনীতি সংস্কারের প্রথম ও জরুরি পদক্ষেপ। শ্বেতপত্রটি সেই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিলো।