ক্যাপ্টেন (অবঃ) মারুফ রাজুঃ নতুন নতুন আলোচনার জন্ম দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। লন্ডনের ফ্ল্যাট থেকে প্রাপ্ত আয় লুকানো, লন্ডনে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিনামূল্যে ফ্ল্যাট উপহার, ব্যারিস্টার আরমানের স্ত্রীকে হেনস্তা করানোসহ বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বেশ চাপে আছেন টিউলিপ। এমনকি খালা শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রশ্ন করায় এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে হুমকিও দিয়েছিলেন টিউলিপ। ব্রিটেনের দুর্নীতি দমন এই মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে দেশটির প্রধান বিরোধীদল কনজারভেটিভ পার্টিও। এবার দুর্নীতির অভিযোগ অভিযুক্ত টিউলিপকে নিয়ে কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, লন্ডনের যে ফ্ল্যাট টিউলিপ ব্যবহার করছেন, সেটির (মালিকানা নিয়ে) তদন্ত করা উচিত। যদি তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় তবে এটি ‘স্পষ্টতই ডাকাতির’ মাধ্যমে পেয়েছেন। তাহলে ফ্ল্যাটটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে ফেরত দেওয়া উচিত।
বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই সাক্ষাৎকার দেন ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাৎ তদন্তের অংশ হিসেবে ব্রিটেনে টিউলিপের ব্যবহৃত লন্ডনের বাড়িগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি সানডে টাইমসসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পানামা পেপারসে কেলেঙ্কারিতে নাম থাকা একটি অফশোর কোম্পানি কিনেছিল, এমন একটি বাড়িতে দীর্ঘদিন বাস করেছেন টিউলিপ। বাড়িটি লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এলাকায়। ওই অফশোর কোম্পানির সঙ্গে দুজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর যুক্ত থাকার প্রমাণ মিলেছে। যদিও টিউলিপ এর আগে অভিযোগ তুলেছিলেন, এই ধরনের ট্রাস্ট ব্যবহার করা হয় স্বচ্ছতা না থাকলে।
সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, টিউলিপ সিদ্দিকের মতো একজন দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী নিজেই যখন অভিযোগের মুখে থাকেন, তা আসলে ‘নির্মম রসিকতা’ হয়ে যায়। তিনি দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী হলেন, তারপর (লন্ডনের সম্পত্তি নিয়ে) নিজের পক্ষে সাফাই গাইলেন। হয়তো আগে বিষয়টি বুঝতে পারেননি। কিন্তু এখন যখন বুঝতে পেরেছেন, তখন তো বলা উচিত, “দুঃখিত, তখন আমি বিষয়টি বুঝিনি, আমি জনগণের কাছে ক্ষমা চাইছি এবং পদত্যাগ করছি।” কিন্তু তিনি তা না করে উল্টো নিজের পক্ষে সাফাই গাইছেন।’
যদিও ড. ইউনূস স্বীকার করেছেন, টিউলিপের পদত্যাগ করা উচিত কি না, তা তার বলার বিষয় নয়।
প্রধান উপদেষ্টা সাম্প্রতিক এক অফিশিয়াল প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের এলিট শ্রেণি প্রতি বছর দেশ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। এই অর্থের একটি অংশ বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পত্তি কেনায় ব্যবহার করা হয়েছে।
ড. ইউনূস বলেন, প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে কীভাবে টাকা চুরি হয়েছে। কিন্তু এটা চুরি নয়—কেউ চুরি করলে তা গোপন রাখে। এটা প্লেইন ডাকাতি।
শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা লন্ডনে যেসব সম্পত্তি ব্যবহার করেছেন, সেগুলো এই ধরনের ডাকাতির অংশ হতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই, এটা প্লেইন ডাকাতির ব্যাপার। আর কিছু নয়।
‘যুক্তরাজ্যের কোনো পার্লামেন্ট সদস্য যদি এতে জড়িত থাকেন, তবে এটা অবশ্যই বড় ইস্যু।…আমরা তো (আগের সরকারের) সব লুটপাটে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আপনারা এই ইস্যু বিশ্ববাসীর নজরে আনায় আমরা স্বস্তি বোধ করছি।
ড. ইউনূস বলেন, দুর্নীতিতে গোটা বাংলাদেশ কলুষিত হয়ে গেছে। দুর্নীতির মাত্রা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “কলুষিত” শব্দটিও খুব কম হয়ে যায়। (দেশ) পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। (হাসিনার শাসনামলে) বিন্দুমাত্র সততা বা স্বচ্ছতা ইচ্ছা ছিল না। তারা নির্দ্বিধায় সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।
টিউলিপের সম্পত্তিগুলো নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করা উচিত কি না—এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, অবশ্যই। কমিশনের উচিত ‘পুরো বিষয়টি’ খতিয়ে দেখা। আওয়ামী লীগের সহযোগীদের কেনা সম্পত্তি যদি সম্ভব হয়, তবে ফেরত আনা উচিত। এটাই অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য। কীভাবে সেগুলো ফেরত আনা যায়। কারণ এখানে জনগণের টাকার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। আর জনগণ বলতে আমি ওই বিলিয়ন ডলারের মানুষদের কথা বলছি না, সাধারণ মানুষের কথা বলছি।
বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সহায়তা দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন ইউনূস। ব্রিটেনে এফবিআইয়ের সমতুল্য সংস্থা এনসিএ গত অক্টোবরে ঢাকায় কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছে। অনুরোধ পেলে যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি, এমনকি জমাকৃত অর্থও ফ্রিজ করতে প্রস্তুত আছে সংস্থাটি।