হঠাৎ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তঃ নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস না যেতেই বছরের শুরুতে জনজীবনে অভিশাপ হয়ে আসছে বিদ্যুতের দাম। এরই মধ্যে পাঁচটি বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থার প্রস্তাবের ভিত্তিতে চারটির শুনানি শেষ করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আজ বাকি শুনানি শেষে ১৫ মার্চের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিতে চায় কমিশন, যা ১ মার্চ থেকেই কার্যকর হবে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানি ও গ্রাহক ভেদে ৬ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হতে পারে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।এদিকে নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস না যেতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিদ্যুতের দাম না বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম। সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, পিডিবি সম্প্রতি সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছে তা কার্যকর হলে মানুষের মাঝে বৈষম্য দেখা দেবে। গরিব লোকের পক্ষে বিদ্যুৎ ব্যবহার অসম্ভব হয়ে পড়বে।& বিএনপি গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবে তারা। এদিকে দুই দিন ধরেই এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সামনে বিক্ষোভ করছে সিপিবি ও বাসদ। বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ এটাকে নতুন সরকারের উপহার হিসেবে মন্তব্য করেছেন।অর্থনীতিবিদদের মতে, বিগত কয়েক মাসের রাজনৈতিক সহিংসতার মুখে দেশের সব শ্রেণীর মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এতে নিু আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়বে। কৃষি থেকে শিল্প সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের মতে, সরকারের ভুল পরিকল্পনা ও দুর্নীতির কারণেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত এক-দেড় বছরে জ্বালানির দাম বাড়েনি। তাই বর্তমানে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কৃষির ওপর বড় ধরনের আক্রমণ। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর আক্রমণ।তিনি বলেন, মূলত সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আর সেই বোঝা মানুষের কাঁধে চাপানো হচ্ছে। সরকার মানুষ নয়, দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করেছে। বছরের পর বছর ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে রেখেছে। এগুলোর মেয়াদ বাড়াচ্ছে। কেউ কেউ এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই শত শত কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে তারাই লাভবান হবে। এসব দুর্নীতি দূর করলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে যাবে। তখন বর্তমান মূল্যের চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ দিতে পারবে তারা।বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগের সমালোচনায় মুখর ব্যবসায়ী সমাজও। এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় সরকারের কিছুটা ভর্তুকি কমবে। সেটা ভালো দিক। তবে যে হারে বিদ্যুতের বিল বাড়ছে তাতে অচিরেই শিল্প খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তার মানে দেশের অর্থনীতি চরম চাপের মুখে পড়বে। ব্যবসায়ীরা শুনতে চান কুইক রেন্টাল কবে নাগাদ বিদায় হবে। এ পদ্ধতিতে বিলের চাপে শিল্প চালানো যাবে না। এখনই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতায় রপ্তানিমুখী শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হয়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক নয়। আমরা মনে করি, ব্যবসায়ীদের আরও কিছুটা সময় দেওয়া উচিত। আগামী ছয় মাস পর বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হোক। তাতে ব্যবসায়ীরা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবপিডিবি : বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) মাসে সর্বোচ্চ ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারী সবচেয়ে গরিব আবাসিক গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের (এক কিলোওয়াট ঘণ্টা) দাম ১ টাকা ৩৭ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। অন্যদিকে মাসে ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের দাম বাড়াতে বলেছে মাত্র ২ পয়সা। জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কৃষি খাতকে সব সময় গুরুত্ব দেওয়া হলেও এবার সেচ পাম্পে ব্যবহƒত বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৫১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আবাসিক, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যিক সব শ্রেণীর বিদ্যুতের দাম গড়ে ১৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পিডিবি। মঙ্গলবার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানি শেষে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন দল পিডিবির বিদ্যুতের মূল্য ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রাহক জামানতও বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পিডিবি। বর্তমানে চাহিদার বিপরীতে প্রায় দুই মাসের আনুমানিক বিলের সমপরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে দিতে হয়। এখন পিডিবি তিন মাসের গড় বিলের সমপরিমাণ কিংবা প্রতি কিলোওয়াট চাহিদার জন্য ১ হাজার টাকা জামানত হিসেবে জমা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে।ওজোপাডিকো : পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) গড়ে ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। ওজোপাডিকোর প্রস্তাবে সবচেয়ে গরিব আবাসিক গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিটে ১৭ পয়সা এবং সবচেয়ে ধনী আবাসিক গ্রাহকের জন্য প্রতি ইউনিটে ৮২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবের ভিত্তিতে মঙ্গলবার শুনানি শেষে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন দল ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বাড়ানো যৌক্তিক হতে পারে বলে মত দিয়েছে।ডিপিডিসি : ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) সব ধরনের গ্রাহকের ক্ষেত্রে গড়ে বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। গতকাল শুনানি শেষে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি।ডেসকো : ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহকের ক্ষেত্রে গড়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ দশমিক ৯০ বৃদ্ধির দাবি জানায়। গতকাল শুনানি শেষে ২ দশমিক ০১ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বিইআরসির মূল্যায়ন কমিটি।আজ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এর পরই ১৫ মার্চের মধ্যে বিদ্যুতের নতুন মূল্য ঘোষণা করবে বিইআরসি। সর্বশেষ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে খুচরা বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ এবং পাইকারির দাম ১৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। বর্তমানে এ পাঁচ কোম্পানি বিভিন্ন স্লাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২ টাকা ৫১ পয়সা থেকে ১১ টাকা ৮৫ পয়সা পর্যন্ত দাম রাখছে।দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য গত পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলচালিত ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক (কুইক রেন্টাল) বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য স্থাপন করা হয়। এসব কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম বেশি। পাঁচ বছরের মধ্যে কয়লা ও কিছু গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুতের দামে সামঞ্জস্য আনার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী বড় কোনো কেন্দ্র চালু না হওয়ায় এবং বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনে বিরোধিতা থাকায় বেশি দামের তেলভিত্তিক কেন্দ্রই আরও বেশি দিন চালাতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম।