ছুটির সকালে আলস্য করে একটু দেরীতেই ঘুম থেকে উঠি। কিন্তু সেদিন মোবাইলটা এক ঘেয়ে ভাবে বেজেই চলছিলো। আমার খুব প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় একজন জানালেন কোকোভাই আর নেই। চিরদিনের মতো আমরা তাকে হারিয়েছি। ঘুম ভেঙ্গেই এমন একটি খবর শুনবো কখনো ভাবিনি ।ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছিলোনা। হতব্হিবল হয়ে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকলাম। এরপর তাৎক্ষনিক কর্তব্য স্থির করতে আর একটা মুহূর্ত ও দেরী করলাম না।
এভাবে তাকে নিয়ে পাস্ট টেন্সে লিখবো কখনো ভাবিনি। কিন্তু আল্লাহ তালা এটাই নির্ধারন করে রেখেছিলেন। ব্যক্তি জীবনে খুবই সাদামাটা কোকো ভাইয়ের পুরোটা জীবন ছিলো বৈচিত্রময়। ১৯৬৯ সালের ১২ই আগস্ট তার জন্ম হয়েছিলো হাসপাতালে নেয়ার পথে এম্বুলেন্সে। পবিত্র আরাফাত ময়দানের নামানুসারে ছেলের নাম আরাফাত রহমান রেখেছিলেন বাবা জিয়াউর রহমান । হাজীদের কষ্ট লাঘবের জন্য পরর্বতীকালে জিয়াউর রহমান সেখানে নিম গাছ রোপণ করেন। আরবরা এই গাছের নাম দিয়েছে ‘জিয়া নিম‘। বাসায় আরাফাতকে আদর করে কোকো নামেই ডাকা হতো। এছাড়া তার আরেকটি নাম ছিলো দোদো। বাবার খুবই প্রিয় ছিলো এই লাজুক ছোট ছেলেটি। আর মায়ের কাছে আদরের ছোট মানিক। বাবার মতো শ্যামবরন গায়ের রং আর কি গভীর মায়াময় চোখের চাহনী।
১৯৭১ সাল বাবা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সমুখ সমরে। যুদ্ধের ডামাডোলে বড়ভাই পিনো আর মায়ের সাথে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। ছোট্ট কোকো একটু দুরে খেলা করছিলো আর বড় ভাইয়া বসেছিলো মায়ের পাশে। হঠাৎ মায়ের মনে কি হলো তিনি গিয়ে ছোট ছেলেকে কোলে তুলে সেখান থেকে নিয়ে আসলেন আর পরমুহুর্তেই একটা মর্টার শেলের আঘাতে হুড়মুড় করে ছাদ ভেঙ্গে ধ্বসে পড়লো কোকো যেখানটাতে খেলছিলো ঠিক সেই জায়গায়। সেদিনকার মতো প্রানে বেঁচে যান তিনি ।
ছোটবেলায় খুবই দুরন্ত ছিলেন। ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান‘ সিরিজ দেখে নিজেকেও তাই ভাবতেন। কল্পনা করতেন তিনি এসেছেন রকেটে করে। একবারতো সিঁড়ির উপর থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে পা টাই ভেঙ্গে বসলেন। এরপর তাকে নিয়ে হাসপাতাল ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি , সে এক হুলুস্থুল কান্ড। ছোটবেলায় প্রায়ই তিনি খাট থেকে মেঝেতে পড়ে যেতেন । কার্পেট না থাকায় শক্ত মেঝেতে পড়ে পড়ে মাথাটা হয়েছিলো খুবই শক্ত। আবার পা দিয়ে গাড়ী আটকাবার ছেলেমানুষী চেষ্টা করতেন তিনি ।আর সারাদিন ক্রিকেট খেলা । কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে এসব দুরন্তপনা একেবারে চলে গিয়ে কোকো হয়ে যান একেবারে শান্ত ।
শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন বিএএফ শাহীন স্কুলে। এরপর বাবা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে যোগ দিয়ে জাতীয়তাবাদী দলের হাল ধরলে মা তাকে পাঠিয়ে দেন চাচার কাছে যুক্তরাজ্যে। এখান থেকেই তিনি ও লেভেল শেষ করে আমেরিকা চলে যান। আমেরিকা থেকে এ লেভেল শেষ করেন। এরপর তিনি অষ্ট্রেলিয়া থেকে সিভিল এভিয়েশনে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহন করেন । রেজির্ষ্টাড পাইলট ছিলেন কোকো ।কিন্তু মা ভয় পেতেন বলে আর পাইলট হিসাবে যোগ দেয়া হয়ে উঠেনি। ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমি মায়ের কোলে বাংলাদেশে। ভালোবাসতেন দ্রুতগতিতে গাড়ী চালাতে। যেন উড়োজাহাজকে হারিয়ে দিতে চাইতেন তিনি ।লেদার জ্যাকেট পরা সানগ্লাস পরা যুবকটিকে দেখলে বোঝাই যেতোনা যে বুঝতে শিখার পর থেকে কোনদিন রোজা বাদ দেননি ।নামাজ পরতেন নিয়মিত। ধর্মীয় রীতি বিরুদ্ধ বলে জন্মদিনের কেক কাটতে চাইতেন না তিনি।
বাবার মতোই খুব সাধারন জীবন যাপন করতেন আরাফাত রহমান । খেতেন খুব অল্প পরিমানে। হই হুল্লোড় জোরে মিউজিক পছন্দ করতেন না। নিরিবিলি জীবন পছন্দ করতেন তিনি। ভাবীদের পীড়াপীড়িতে একবার কনসার্টে গিয়ে কিছুক্ষন পরেই রেগেমেগে বললেন আমাকে এ কোথায় নিয়ে আসলেন ।শেষে বিরক্ত হয়ে মোবাইলে গেইম খেলে সময় কাটালেন ।ভাবীদের কাছে ছিলেন আদরের ছোটভাই । সারাক্ষন মাতিয়ে রাখতেন তাদের । নিয়মিত খেলাধুলা করতেন কোকো। নিজে ক্রিকেট পাগল হলেও ফুটবলে প্রিয় দল ছিলো ব্রাজিল। বিশ্বকাপ আসলে সোৎসাহে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ব্রাজিলের খেলা দেখতেন।
ক্রীড়াপ্রেমী কোকো ‘ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান‘ থাকাকালীন বিসিবিকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। তার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় তৈরী করেছে বিকেএসপি। আজকের বিশ্বসেরা সাকিব, তামিম, মুশফিকরা তারই হাতেগড়া ।ওল্ড ডিওএইচএস এর চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেটে তার অসামান্য অবদান স্বীকার করতেই হবে। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর উদ্যোগে বগুড়াতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম তৈরী করা হয়। শহীদচান্দু স্টেডিয়াম নিয়ে বগুড়াবাসী যেমন গর্বিত তেমনি কোকোর স্থান তাদের হৃদয়ের মনিকোঠায়।
হৃদয় ভরা ভলোবাসা নিয়ে জন্মেছিলেন কোকো। আর পেয়েছেনও সবার ভালোবাসা। বাবা মার আদরের সন্তান আর বড়ভাই তারেক রহমানের প্রানের অধিক প্রিয় ছোটভাই। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন শর্মিলা রহমান সিঁথি কে। ছিলেন প্রানপ্রিয় স্বামী আর দুই কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা ।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও বরাবরই তিনি থেকেছেন রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। রাজনীতি তিনি করতেন ও না রাজনীতি বুঝতেও চাইতেন না। অসম্ভব শান্তিপ্রিয় একজন সদ্লাপী মিশুক মানুষ ছিলেন তিনি। আর তাইতো বন্ধুবৎসল কোকো ছিলেন সকলের প্রিয়। সাদামাটা একটি ছেলে প্রথম দেখায় তেমন আলাদা মনে না হলেও তীক্ষ চোখের দৃষ্টি কারো নজর এড়াতোনা। বাবার মতো ভরাট গলা আর অসম্ভব সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতেন তিনি। আর নেতৃত্ব দেয়ার সহজাত গুনের কারনে বন্ধুমহলে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়।
রাজনৈতিক কোন অভিলাষ না থাকলেও দূর্ভাগ্যজনক ভাবে রাজনীতির বলি হতে হয় আরাফাত রহমানকে। ২০০৭ সালে তাকে গ্রেফতার করে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। জড়ানো হয় ষড়যন্ত্রমুলক বিভিন্ন মামলায়। তাকে ধরে নিয়ে যাবার সময় নির্ভীক কোকো অফিসারদের ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমাকে নিতে এসছেন ? কোথায় যেতে হবে ? চলেন..
কিন্তু গাড়ীতে তুলেই তার হাত পিছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয় আর কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর রিমান্ডে নিয়ে চালাতে থাকে অমানুষিক শারিরিক ও মানসিক নির্যাতন। দুই ভাইকে রাখা হয় একই জেলখানার দুই ব্লকে। যাতে করে জেলখানার ভিতরে দুই ভাইয়ের সাক্ষাত না হয়। টগবগে তরুন কোকোকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আর ২০০৮ সালে জেল থেকে বের করা হয় হুইল চেয়ারে করে।
খুব ভালো ছবি তুলতেন কোকো। তার অসাধারন ফটোগ্রাফি সত্যি যে কাউকে বিমোহিত করবে । প্রকৃতির ছবি তুলতেই বেশী ভালোবাসতেন তিনি । মালয়েশিয়ার নির্বাসিত জীবনে বড্ড অভিমানী এই মানুষটি ফটোগ্রাফীকেই একমাত্র সঙ্গী করেছিলেন। বন্দী জীবনের অপমানের কষ্ট কিছুতেই ভুলতে না পেরে অনেকটা নিঃসঙ্গ নিভৃত জীবন কাটিয়েছেন আরাফাত রহমান। কোন অপরাধ না করেও মিথ্যে অভিযোগের বোঝা তাকে অকাল মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। তার এই অকাল প্রয়াণ ছুঁয়ে যায় প্রতিটি হৃদয়বান মানুষের মন। তার জানাজায় শরীক হতে সাধারন মানুষের ঢল নামে। মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের মতো প্রতিটি জনস্রোতের লক্ষ্যস্থল ছিলো একটাই বায়তুল মোকাররম মসজিদ। এই জনসমুদ্রের দোয়া আরাফাত রহমানের জন্য ।এই জনসমুদ্রের ভালোবাসা ও সহমর্মীতা জিয়া পরিবারের জন্য।
ছোট্টবেলায় বাবাকে হারিয়ে বাবার আদর থেকে হয়েছেন বঞ্চিত ।পড়াশুনার জন্য দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় আর সবশেষ রাজনীতির বলি হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রানপ্রিয় মা এবং বড়ভাইয়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কোটি মানুষের হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা প্রমাণ করে দিয়েছে আসলে তিনি কারো ভালোবাসা থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হননি। তিনি আছেন লক্ষ কোটি হৃদয়ে।