উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেদারছে উড়ছে টাকা। ভূঁরিভোজ, মিলাদ মাহফিলের নামে মিষ্টি বিতরণ, বিভিন্ন ক্লাব-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান খয়রাত ইত্যাদি কোথাও গোপনে, কোথাও প্রকাশ্যে চলছে। এছাড়া ভোট কেনা-বেচারও ঘটনা ঘটছে। উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ (ভোটারের সংখ্যানুপাতে) ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচের বিধান রয়েছে। এই ব্যয়সীমা অধিকাংশ স্থানেই লংঘিত হচ্ছে।
ব্যয় নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বা রিটার্নিং অফিসারদের কোন কার্যক্রম নেই। আজ পর্যন্ত দেশের কোন নির্বাচনে নির্ধারিত ব্যয়ের বেশি ব্যয়কারী কোন প্রার্থীকে চিহ্নিত করা যায়নি। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের উদাসীনতা এবং নির্বাচনী এলাকায় যথাযথ মনিটরিং না হওয়ার কারণে এটি কোনদিন সম্ভব হয়নি।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা, ২০১৩ এর বিধি ৫১ তে, নির্বাচনী ব্যয়ের সীমার পাশাপাশি চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ভোটারের সংখ্যানুপাতে ব্যক্তিগত ব্যয় নির্ধারণ করা আছে।
তিনটি পদের প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকার সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যয় সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকার কথা বলা আছে। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনে কোন্ কোন্ খাতে খরচ করা যাবে তার একটি নির্ধারিত ছক আছে। এর মধ্যে পোস্টার, প্রচারপত্র, মাইক, ব্যানার, নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচনী ক্যাম্প, ভোটার স্লিপ এবং কর্মী পরিচালনা বাবদ নির্বাচনী ব্যয় করা যায়। কি পরিমাণ পোস্টার ছাপা হয়েছে তার সংখ্যা পোস্টারে উল্লেখ করতে হয়। কোন কোন প্রার্থী তার নির্বাচনী ব্যয়ের প্রায় সম্পূর্ণ টাকা পোস্টার ছাপানোর পেছনেই ব্যয় করে থাকেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোন প্রার্থীই পোস্টারে প্রকৃত সংখ্যা উল্লেখ করছেন না। প্রার্থীরা নিজে তার বাড়িতে কর্মী বা ভোটার ভোজের আয়োজন না করলেও কৌশলে তাদের সমর্থকদের দিয়ে গ্রামে-গ্রামে ভোজের আয়োজন করছেন। এসব ভোজের জন্য প্রকাশ্যে গরু, খাসি জবাই করা হচ্ছে। কিন্তু তা দেখার কেউ নেই। মিলাদ মাহফিলের নামে মিষ্টি বিতরণ তো আছেই।
আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, অনেক উপজেলায় কর্মীদের গোপনে মোবাইল সেটও সরবরাহ করছেন প্রার্থীরা। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটছে ভোটের আগে দুই রাতে। ওই সময়ে দরিদ্র বা তৃণমূল এলাকায় ভোটার কেনা-বেচা হচ্ছে। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ২০৮টি উপজেলা নির্বাচনে বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে।
আগামী ১৫ মার্চ হবে তৃতীয় ধাপে ৮৩ উপজেলা নির্বাচন। এই ধাপের নির্বাচন নিয়ে চলছে টাকার ছড়াছড়ি। ভোটাররা জানিয়েছেন, সারা বছর খোঁজ না নিলেও ভোটের সময়ে ঠিকই তারা খোঁজ নেন আমাদের। তবে সাহায্য-সহযোগিতার নামে অর্থ দিয়ে ভোট কিনতে আসেন প্রার্থীরা। এ বিষয়ে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার ভোটার সেলিম, মোস্তাফিজুর ও মহিদুল্লাহ ইত্তেফাককে জানান, এখন প্রকাশ্যে ভোট কেনা-বেচা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কিছু করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার ভোটার পারভীন আক্তার বলেন, 'আমরা দিন আনি দিন খাই। পরের বাড়ি কাজ করলে খাবার হয়, নয়তো না খেয়ে থাকতে হয়। একটু বৃষ্টি হলে ঘরবাড়ি ডুবে যায়। মালিকও ঠিক করে না। আর কাউকে উপকার করতে আসতে দেখি না। এহন সবাই ভোট চায়। কি আর করমু টাকা যে দিবি তাকে ভোট দেব।'
২৩ মার্চ চতুর্থ ধাপের ৯২টি উপজেলা নির্বাচন হবে। গত শুক্রবার প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হয়েছে। এখানেও বিভিন্ন কৌশলে প্রার্থীরা টাকা ছড়ানো শুরু করেছেন। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার ছাড়াও প্রত্যেক উপজেলায় ৪ জন নির্বাহী ও ১ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানা ও দণ্ড দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। সার্বিক বিষয় তদারকির জন্য মোবাইল কোর্ট ও পর্যবেক্ষণ দল রয়েছে। কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানা যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পোস্টার লাগানো সংক্রান্ত অনিয়ম, অধিক মাইক ব্যবহার, মিছিল করা ইত্যাদি অপরাধেই (নির্বাচন পূর্ব অনিয়ম) শুধু জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু প্রার্থীদের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে এ কর্মকর্তাদের কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনি। প্রার্থীদের একটি তফসিলী ব্যাংকে হিসাব খুলে নির্বাচনী ব্যয় পরিচালনার বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রার্থী নামেমাত্র ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। মূল টাকা ব্যয় তারা ব্যাংক থেকে নয়, পকেট থেকে করেছেন। যাতে হিসাবে তারা ধরা না পড়েন।
এছাড়া প্রার্থীরা কোন্ কোন্ খাতে ব্যয় করবেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় তারও একটি বর্ণনা দেন। ওই বর্ণনা অনুযায়ী ব্যয় হচ্ছে কিনা তারও তদারকি হয় না। এর সত্যতা স্বীকার করে ইসি সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে জানান, এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত যেকোন নির্বাচনে ব্যয়ের সীমা লংঘনকারী কাউকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানা নেই। ব্যয়ের সীমার বিষয়টি মোবাইল কোর্ট ও পর্যবেক্ষক দল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু এ বিষয়ে সুষ্ঠু মনিটরিংয়ের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তবে ব্যয়ের রিটার্নিং জমাদানে ব্যর্থ হয়েছেন-এমন নির্বাচিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ ইত্তেফাককে বলেন, নির্বাচনে কালো টাকা ছড়ানোর সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ইস্যুতে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। প্রয়োজনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।