মোবায়দুর রহমানঃ ১৮ বছর আগে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড.তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেছিলেন, ‘ট্রানজিট প্রশ্নে আমি বিএনপি চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি ঘোষণার সঙ্গে একমত যে, রক্তের বিনিময়ে হলেও দিল্লিকে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে করিডোর বা ট্রানজিট দেয়ার উদ্যোগ প্রতিহত করতে হবে।’
বেগম জিয়া সেদিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘ভারতকে যদি ট্রানজিট সুবিধা দেয়া হয় তবে বাংলাদেশ তার স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্ব কোনোক্রমেই টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশ পরিণত হবে ভারতের একটি ‘সঙ্গরাজ্যে’ বা ‘অঙ্গরাজ্যে’।’
ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান একজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। সেই ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান ভারতকে ট্রানজিট প্রদান, উপ-আঞ্চলিক জোট, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি প্রভৃতি বিষয়ে ১৮ বছর আগে ১৯৯৭ সালে বক্তব্য রেখেছিলেন।
এমন তথ্যবহুল জিও পলিটিক্যাল ও জিও স্ট্র্যাটেজিক পটভূমিতে ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানের মতো এমন বিশ্লেষণধর্মী এবং এমন দ্ব্যর্থহীন ও বলিষ্ঠ মন্তব্য ইতিপূর্বে কেউ করেছে বলে মনে পড়ে না। বিষয়টি ১৮ বছরের পুরাতন। তবুও ১৮ বছর পরে তার বক্তব্য পড়লে দেখা যাবে যে, ১৮ বছর আগে তিনি যে সব কথা বলেছেন, ১৮ বছর পর বর্তমান পরিস্থিতিতে সেসব কথা কত বিপুলাংশে ফলে যাচ্ছে।
তাই ড. মনিরুজ্জামানের এই পুরাতন বক্তব্যের সাথে পাঠকগণকে পরিচিত করানো দরকার।কিছুদিন আগে ড. মনিরুজ্জামানের সাথে আমার দেখা এবং কথা হয়েছিল। দেখা হওয়ার পর বুঝলাম, কেন তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলছেন না। দেখলাম, বয়সের ভারে তিনি ন্যুব্জ। দুই-তিন বছর আগে তার পত্নী অর্থাৎ আমাদের রাজিয়া ভাবী ক্যান্সারে মারা গেছেন। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে জীবনসঙ্গী হারালে সেটা অন্যান্য মানুষের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, মনি ভাইয়ের ওপরেও তেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। (তিনি আমার বেশ সিনিয়র। তাই তাকে আমরা মনি ভাই বলেই ডাকতাম)। ৭৭/৭৮ বয়সে এসে তার কথাবার্তাও জড়িয়ে যায়। সম্ভবত সে কারণেই সমকালীন সমস্যা সম্পর্কে তার মূল্যবান মন্তব্য থেকে জাতি বঞ্চিত।
ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি মনে করি যে কোনো মূল্যে ট্রানজিট দেয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করা উচিত। তিনি বলেন, ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার প্রশ্নে ইউরোপের দিকে তাকালে চলবে না। বাংলাদেশকে তাকাতে হবে তার নিজের দিকে। ইউরোপের জাতিসমূহ শত শত বছর লড়াই করে আজ একটি সমতায় এসেছে। অর্থনীতি ছাড়াও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তারা এখন সংশয়মুক্ত। এ সংশয় এ উপমহাদেশে প্রবল। তাই ভারতকে ট্রানজিট দিতে ইউরোপের দিকে তাকালে চলবে না। বাংলাদেশকে তাকাতে হবে তার নিজের দিকে। ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জন্য যারা ওকালতি করেন তারা কথায় কথায় পয়সাকড়ি বা মুনাফার টোপ ফেলেন।’ এদের এই দুরভিসন্ধিমূলক যুক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন ড. তালুকদার।
এ প্রসঙ্গে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. গাঙ্গুলির একটি উক্তি স্মরণ করেন। প্রফেসর গাঙ্গুলি বলেছেন, “ভারতের ব্যবসায়ী, বিশেষ করে মাড়োয়ারিদের, আপনাদের দেশে কিছুতেই ঢুকতে দেবেন না। কারণ, ‘দে সাকড (Suck) ক্যালকাটা, দে উইল সাক বাংলাদেশ।’ (তারা কলকাতাকে চুষে নিয়েছে, বাংলাদেশকেও তারা চুষে নেবে)। এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে যে, কলকাতা আজ অবাঙালি মাড়োয়ারিদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? অধিকাংশ বৃহৎ শিল্প কারখানাই তো তাদের নিয়ন্ত্রণে।
॥ দুই ॥ট্রানজিট চাওয়ার পেছনে ভারতের মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান বলেন, আগামী শতাব্দীর গোড়াতেই একটি নতুন কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর সে সময়টাতে ইন্ডিয়া ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এ রকম একটি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে ভারত এখন থেকেই চারদিক গুছিয়ে নিতে চাইছে।
ড. মনিরুজ্জামান তার এই জ্ঞানগর্ভ মন্তব্যসমূহের মাঝে এমন একটি তথ্য দিয়েছেন যেটা ইতিপূর্বে আর কেউ দিয়েছেন বলে মনে হয় না। যারা সত্যি সত্যি চান যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকুক তারা মনিরুজ্জামানের এই তথ্যটি নিয়ে গভীরভাবে ভাববেন বলে আমরা আশা করি।
ড. মনিরুজ্জামান আফ্রিকার বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলফ মজরুল কর্তৃক মধ্য সত্তর দশকে দেয়া একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা উল্লেখ করেন। এটি তিনি প্রথমে প্রকাশ করেছিলেন জাপানে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে। পরে তার বক্তব্যটি লন্ডনে ‘ইন্টারন্যশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের’ জার্নালে ছাপা হয়। তিনি বলেছিলেন, “বিশ্বে যদি কখনও পরমাণু যুদ্ধ হয় তবে তা হবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেই। কারণ এই দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের রেষারেষি, বিদ্বেষ ও ঘৃণা আছে তা বিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চলে নেই।”
ঐ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছিলেন, “ভারত যখন পরমাণু বোমা বানিয়েছে তখন পাকিস্তানও একদিন তা তৈরি করবেই।” প্রফেসর আলীর মতে, পৃথিবীর এটাই হবে শেষ পরমাণুযুদ্ধ। কারণ এই যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর পরিবেশ এত দূষিত হয়ে যাবে যে, হিরোশিমা ও নাগাসাকি সে তুলনায় হবে ‘টি পার্টি’। এ যুদ্ধের ভয়াবহতার মুখে পৃথিবীর অন্য সব দেশ তাদের অস্ত্র সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। প্রফেসর আলী ১৯৯৭ সালে ইসলামাবাদ সফর করেন।
ড. মনিরুজ্জামান বলেন, তার ভবিষ্যদ্বাণীর আংশিক সত্যে পরিণত হয়েছে। কারণ এই দুটো দেশই এখন পরমাণু বোমার অধিকারী। আর আমি মনে করি যে, পাকিস্তানের হাতে অ্যাটমবোমা রয়েছে বলেই ভারত আজ কাশ্মীর দখল করে নিতে সংযমের পরিচয় দিচ্ছে। অন্যথায় তারা হয়ত সেই সংযম দেখাত না।বর্তমানে ভূরাজনীতিতে যে পরিস্থিতি বিরাজমান তার ফলে আগামী দিনে বড় আকারের যুদ্ধ বাধার কোনো আশঙ্কা নেই। এ ক্ষেত্রে একটিমাত্র ব্যতিক্রম রয়েছে। সেটা হলো দক্ষিণ এশিয়া। আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়া পরবর্তী যুদ্ধের রণক্ষেত্র হবে বলে অনেকে আশঙ্কা করেন। এই যুদ্ধ সনাতনী (কনভেনশনাল) বা পারমাণবিক, যে কোনোটি হতে পারে।
সম্ভবত সেই কারণেই প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আমেরিকা তার বিশ্ব রাজনীতির ফোকাসে দক্ষিণ এশিয়াকে সামনে এনেছে।
আজ ২০১৫ সালে দেখা যাচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্যের ওপর আমেরিকা যত গুরুত্ব দিত তার প্রায় সমপরিমাণ গুরুত্ব দক্ষিণ এশিয়ার ওপর দেয়া শুরু করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহৎ দেশ হিসেবে বাংলাদেশও পশ্চিমা দুনিয়ার কাছে এখন বিশেষ গুরুত্ব লাভ করছে।
আজ নয় ১৮ বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যখন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন তখন তার সফরসঙ্গী ছিলেন তার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন র্যাফেল। সেদিন বাংলাদেশ সফর শেষে রবিন র্যাফেল বলেন যে, দক্ষিণ এশিয়া আমেরিকার নিকট স্ট্রাটেজিক্যালিও (অর্থাৎ সামরিক গুরুত্বের দিক দিয়ে) গুরুত্বপূর্ণ।
তিন ॥এ কথাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, ভবিষ্যৎ পাক-ভারত যুদ্ধকে সামনে রেখে ভারত উপমহাদেশের ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকে সাথে নিয়ে একটি পাকিস্তানবিরোধী সামরিক ব্লক গঠন করতে যাচ্ছে। উপ-আঞ্চলিক জোট পাকিস্তানবিরোধী সেই বৃহত্তর সামরিক জোটেরই প্রথম পদক্ষেপ। এই সামরিক জোটের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো চট্টগ্রাম বন্দর। সেজন্য ভারত চট্টগ্রাম বন্দরেও ট্রানজিট চায় এবং এবার শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, ভারত মংলা বন্দর ব্যবহারেরও অধিকার পেয়ে গেছে।
১৮ বছর আগে এ সম্পর্কে ড. মনিরুজ্জামান বলেন, ভারতের মূল দৃষ্টি চট্টগ্রাম বন্দরকে কব্জা করা। সামরিক, অর্থনৈতিক ও সর্বোপরি বাংলাদেশের তেলসহ অন্যান্য অনাবিষ্কৃত খনিজসম্পদের ওপর খবরদারি সে ভালোভাবে করতে পারবে যদি চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর কোনোভাবে একবার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তিনি বলেন, কলকাতা বন্দরের আর ভবিষ্যৎ নেই। এর সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ৪০ হাজার কিউসেক কেন, এর বেশি পরিমাণ পানি দিয়েও কলকাতা বন্দরকে আর সিংহদ্বার করা যাবে না। ভারত সেটা বুঝতে পেরেই চট্টগ্রাম বন্দর পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ড. মনিরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে তেলসম্পদ আহরণে ১৯৭৫ পূর্ব আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃখজনক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বলেন, দিল্লির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে শেখ হাসিনাকে এ ঘটনা ও তার সুদূরপ্রসারী পরিণাম সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। ড. মনিরুজ্জামান বলেন, আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভারতের নৌবাহিনী সেদিন একটি আমেরিকান কোম্পানির জাহাজকে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদায় নিতে বাধ্য করেছিল। তিনি বলেন, মার্কিন প্রফেসর Marfus Franda বাংলাদেশের একজন বন্ধু। তিনি তার ‘বাংলাদেশ দি ফার্স্ট ডিকেড’ বইতে ঐ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। বইটি ১৯৮১ সালে দিল্লিতে প্রকাশিত হয়। ফ্রান্ডা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ফ্রান্ডা উল্লেখ করেন, “…Even while the so called fifth round of talks looked promising, optimism evaporated when the Indian navy physically prevented an American Oil Company vessels from exploring, on behalf of Bangladesh, a disputed area. Shortly after the incident the Bangladesh government shifted its stance on the boundary issue claiming even more of the sea bed than it had originally. (বাংলাদেশ দি ফার্স্ট ডিকেড পৃ. ১৩২)ড. মনিরুজ্জামানের কথা সত্য হয়েছে।
ভারত এশিয়ার দুটি পরাশক্তির একটি হিসেবে উত্থিত হয়েছে। অপর পরাশক্তিটি হলো গণচীন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি এবার ২০১৫ সালের জুন মাসে অত্যন্ত নির্মমভাবে ভারতের পেশিশক্তি প্রদর্শন করেছেন। তার সেই পেশি সঞ্চালনের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নড়েচড়ে বসেছে পাকিস্তান, মিয়ানমার এবং গণচীন।
মিয়ানমারে তিনি শুধু সামরিক অভিযানই চালাননি, তাদের সামরিক শক্তি নিয়েও দম্ভ করেছেন। তার এই দম্ভের সমালোচনা তার দেশের মধ্যেই প্রবলভাবে শুরু হয়েছে। তার মন্ত্রী পাকিস্তানকে হুমকি দিয়েছিলেন। তারও পাল্টা শক্ত জবাব এসেছে। ভারতের সামরিক শক্তির দম্ভ প্রকাশের পাল্টা পাকিস্তান তার আণবিক শক্তির হুমকি দিয়েছে। উপমহাদেশের পরিস্থিতি আবার গরম হয়েছে।
ভবিষ্যতে যদি পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয় এবং সেই যুদ্ধে গণচীন, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান নিরপেক্ষ থাকবে বলে মনে হয় না। তেমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কি ভূমিকা গ্রহণ করবে? সমুদ্র বন্দর, ট্রানজিট এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার সাথে এসব প্রশ্ন এসে পড়বে। সেই সব প্রশ্নের জবাব দিতে হবে জিও স্ট্র্যাটেজিক ও জিও পলিটিক্যাল প্রেক্ষিতে।