ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানুষকে গুম করে ফেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার সমস্যা বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটালেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও তাদের অভিমত। যুক্তরাষ্ট্রের সেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার ২০১৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এসব মন্তব্য করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সমস্যা হল, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানুষকে গুম করে ফেলা। বাংলাদেশের মানবাধিকার সমস্যার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন ও হয়রানি, কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতি, নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতন, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং বিচার ছাড়াই দীর্ঘদিন আটক করে রাখা অন্যতম। শাসকগোষ্ঠী নাগরিকদের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করছে।
সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময়ে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিতের নিশ্চয়তার কথা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন ঘটনায় সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালের প্রথম আট মাসে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, র্যাব ও আইনশৃঙ্খখলা বাহিনীর হাতে মোট ১১৩ জন বিচার-বহির্ভূত হত্যার শিকার হন। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, একই বছরের প্রথম নয় মাসে এই সংখ্যা ১৩৬ জন।
এর আগের বছর ২০১৩ সালে মোট ১৭৯ জন বিচার-বহির্ভূত হত্যার শিকার হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান, গ্রেফতার এবং অন্যান্য ঘটনায় বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বেশিরভাগ সময়েই সরকারের পক্ষ থেকে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও প্রতিপক্ষের হামলা বলে মন্তব্য করা হয়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দিনদুপুরে র্যাবের কর্মকর্তারা নারায়ণগঞ্জে অপহরণ এবং সাতজনকে হত্যার ঘটনা ঘটায়। স্থানীয় সরকারদলীয় শক্তির যোগসাজশে ওই ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পরে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয় কিন্তু বছর শেষেও ওই ঘটনার তদন্ত শেষ হয়নি।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এবং গত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক গঠন ব্যবস্থার একটি রাষ্ট্র। যেখানে কার্যকর এবং প্রতিক্রিয়াশীল সুশীল সমাজ রয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ তাদের শাসন ক্ষমতা ধরে রেখেছে। ওই নির্বাচনের আগে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল সহিংসতামূলক কর্মকান্ড ঘটায়। ওই সময়ের বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের শরিকরা (জোট) ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপি এবং তার শরিকরা নির্বাচন নিয়ে তাদের দাবি আদায়ের জন্য ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করতে থাকে।
দিনশেষে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। এতে করে ওই নির্বাচনে ভোটাররা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ওই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট করার আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির ন্যূনতম যুক্তিও খুঁজে পাননি। ওই সময়ে সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি।
নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের মতে, কেন্দ্রে বা এর আশপাশে ওই নির্বাচনে ১০০ এরও বেশি নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ওই বছরের ফেব্রুয়াারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পঞ্চমবারের মতো উপজেলা পর্যায়ের স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত নির্বাচনে সন্ত্রাস, সহিংসতা, কারচুপি এবং নির্বাচনী অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা অবাধে ব্যালট পেপারে সিল মারছে এমন ছবিও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও বলা হয়, মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
পাশাপাশি শ্রম অধিকার এবং শ্রম পরিবেশ নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কয়েকটি দলের সহিংসতা ২০১৪ সালে দেশে ভীষণ ক্ষতির কারণ ঘটায়। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইনি বাধা মোকাবিলা করে এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নারীদের ক্ষেত্রে বৈষম্য চলছে। অল্প বয়সে এবং জোরপূর্বক বিয়ে সমস্যা রয়েছে। অনেক শিশু কাজ করতে বাধ্য হয়।