ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ‘যারা দেশকে রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবে তাদের হাতেই দেশ আজ জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা অবৈধভাবে জনগণকে আটক করছে। টাকা দিতে পারলে ভালো, না হলে গুম করে ফেলছে।’
হবিগঞ্জের বিএনপিপন্থি মেয়র জিকে গউসকে কারা অভ্যন্তরে ছুরিকাঘাতের কথা উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘ঈদের মতো একটি দিনে কারাগারেও মানুষ আজ নিরাপদ নয়।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো, এ সরকারের আমলে কারাগারেও মানুষ নিরাপদ নয়।’ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।
সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে দল কেনো রাজপথে এখনো সক্রিয় হচ্ছে না জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘‘ বিএনপির নামে শুধু মামলা আর মামলা। আমাদের অনেক নেতা-কর্মী জেল আছে। কত ছেলে যে গুম হয়েছে, তার হিসাব নেই। কাজেই বিএনপিকে এখন পূর্ণগঠিত হতে হবে। এরপর আমরা জনগনকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আন্দোলন করবো।’’
পাশাপাশি ‘জ্বালাও-পোড়া’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দলের অবস্থান স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘‘ আমরা সেই আন্দোলন করবো, যে আন্দোলন দেশের জন্যে হবে, মানুষের কল্যাণে হবে। আগেও ওইরকম আন্দোলন আমরা করেছি, আগামীতেও করব। আমরা জ্বালাও-পোড়াও-ভাংচুরের আন্দোলনের বিশ্বাস করি না। সেই আন্দোলন আমরা করিনি। কারা জ্বালাও-পোড়াও করেছে তা দেশবাসী জানে।’’
খালেদা জিয়া বেলা ১১টা ৪২ মিনিট থেকে সোয়া ১২টা পর্যান্ত ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে, সোয়া ১২টা থেকে সাড়ে বারটা পর্যন্ত ৩৯টি দেশের কূটনীতিক ও এম্বাসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে এবং সাড়ে ১২টা পর থেকে সাধারণ মানুষ ও বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের সঙ্গে শুভেচ্ছাবিনিময় করেন।
মুসলিম উম্মাসহ দেশবাসী ও নেতা-কর্মীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘ দেশের মানুষ ভালো নেই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধব গতি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা মধ্যে নেই। রাস্তা-ঘাটের দুরাবস্থার কারণে জনগন যানজটের মুখে পড়ছে।’’ দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘‘ প্রতিদিন কাগজ খুলে দেখা যাবে গুম-খুন-হত্যার খবর। দেশে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু আছে, তা মনে হয় না। প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি চলছে।’’ ‘‘ দেশে মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই। যারা মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার কথা তারাও আজ জনগনকে জিম্মী করে ফেলেছে। তারা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) নিরাপত্তার নামে জনগনকে ধরে নিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। সেই টাকা দিতে পারলে ভালো। না হলে কাউকে জেলে যেতে হয়, কাউকে জীবন হারাতে হয়।’’ সারাদেশে প্রশাসন, পুলিশ ও বিচারবিভাগে দলীয়করণের অভিযোগ করেন খালেদা জিয়া।
‘‘ আজ বিচার হয় দুই রকমের। সরকারি দলের হলে একরকম। আর বিরোধী দল হলে ভিন্ন রকম বিচার হচ্ছে। তারা জামিন পায় না, দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হচ্ছে। বিরোধী নেতা-কর্মীরা সুবিচার পায় না। দেশটাকে অবৈধ সরকার এভাবে কারাগার বানিয়ে রেখেছে।’’
ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশের জন্য এক হয়ে কাজ করার কথা উল্লেখ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘ বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনাময় দেশ। এই দেশকে সকলে মিলে গড়ে তুলতে হলে আমাদের সব বিভেদ ভুলে যেতে হবে। রাজনীতিতে দল থাকবে, তাই বলে যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, কেউ কারো চেহারা দেখবো না। এটা কোনো রাজনীতি হতে পারে না।’’ ‘‘ আমাদের সঙ্গে সামাজিক খাকবে। পারিবারিক সম্পর্কও থাকতে পারে।কিন্তু রাজনীতি যে যার মতো করবে। হানাহানি-খুনাখুনি-মারামারি এগুলো রাজনীতি নয়। শান্তি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র- এই তিনটি হচ্ছে বিএনপির আর্দশ ও লক্ষ্য। আমরা এই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’’
‘দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মেধারভিত্তিতে প্রশাসনে পদোন্নতি দিতে হবে।’ নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়তে তুলতে পারলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করবে বলেও মনে করেন বিএনপির চেয়ারপারসন। বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশনের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘ বর্তমান দুর্নীতি কমিশন একটি করাপশন কমিশনে পরিণত হয়েছে। এখানে শুধু করাপশনের আড্ডা। তারা ধরে নিয়ে গিয়ে টাকা নিয়ে তারপর কার বিরুদ্ধে মামলা দেবে, কার মামলা প্রত্যাহার করবে, ঠিক করে। এটা তো হতে পারে না।এটা নিরপেক্ষ হতে হবে।’’
আবারো অবাধ নিবার্চনে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ দেশের মানুষ আজ অবাধ নিবার্চনে অপেক্ষায় আছে। সরকার ওইরকম একটি নিবার্চন দিতে ভয় পায়। তারা দুর্বল সরকার।’’ ‘‘ সদ্য তিন সিটি করোপরেশনের যে নিবার্চনটা হয়েছে, কিভাবে সেখানে ভোট ডাকাতি হয়েছে। জনগন এই অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।’’
ব্রাজিল থেকে পঁচা গম আমদানির কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই পঁচা গম পুলিশকে দেয়া হচ্ছিল, কিন্তু পারেনি। এখন সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, কিছু ভালো গমের সঙ্গে মিশিয়ে তা যোগ্য করে মানুষকে খাওয়ানো হবে। কিন্তু এতে দেশের কোনো উন্নয়ন হবে না, মানুষের রোগ বৃদ্ধি পাবে।’
খাদ্য মন্ত্রীর প্রতি ইংগিত করে বিএনপি চেয়ারপারসন অভিযোগ করে বলেন, ‘‘ মন্ত্রীরা কীভাবে দুর্নীতি করছে। তারা লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে। যে গম খাওয়ার অযোগ্য, সেই পঁচা গমকে যোগ্য প্রমাণ করে সবাইকে খাবে। ওই পঁচা ও পোকায়ালা গম টিআর, কাবিখা ও রিলিফের মাধ্যমে গরীব মানুষকে খাবেন। তা প্যাকেটের মাধ্যমে আটা হয়ে শহরেও চলে আসবে। তারপরও ওইসব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অ্যাকশন হয় না। তারা দুর্নীতি করে ভালো আছে, আরামে আছে। অবাধে তারা লুটপাট করে যাচ্ছে।’’
কারাগারে্ আটক হবিগঞ্জের আটক নিবার্চিত পৌর মেয়র জি কে গউসকে চুরিকাঘাতের নিন্দ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ কারাগারে ঈদে জামাত পড়তে যাচ্ছি গউস। তাকে ছুরি মারা হয়েছে। আজ কারাগারও নিরাপদ নয়।’’ বিএনপি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় দল হিসেবে অভিহিত করে খালেদা জিয়া দাবি করে বলেন, ‘‘ বাংলাদেশ এখনো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় দল হচ্ছে বিএনপি। সেজন্য একে শেষ করতে তারা (সরকার) উঠে পড়ে লেগেছে। খবরে কাগজে বিএনপির বিরুদ্ধে নানারকমভাবে এজেন্সি ও গ্রুপের মাধ্যমে লেখানো হয়। বিএনপির বিরুদ্ধে বিভেদ, বিএনপিতে ঐক্য নেই- এই হচ্ছে- সেই হচ্ছে। অমুক গ্রুপ-তমুক গ্রুপ। আমি স্পষ্টভাষা বলতে চাই- এগুলো কিচ্ছুই নয়। এগুলো সব সরকারের কারসাজি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি জনপ্রিয় দল, জনগনের সঙ্গে আছে, থাকবে।’’’
খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা অত্যাচারিদের সর্বোচ্চ অত্যাচার দেখেন, তারপর শাস্তি দেন। এই সরকারের অত্যাচার এতই বেড়ে গেছে যে তাদের পতন হবেই।’ শুভেচ্ছা বিনিময়ে প্রথম গণমান্য ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের সঙ্গে কুশল বিনিয় করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
এরপর কুটনীতিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তিনি। কুটনীতিক কোরের ডীন প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রদূত শাহের মোহাম্মদ এইচ আবুইয়াদেহ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মাসির্য়া স্টিফেন্স ব্লুম বানির্কাট, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকসান্দর নিকোলায়েভ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদন, পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলম, ভারতের হাইকমিশনার পংকজ শরণ, নেপালের রাষ্ট্রদুত হেরি কুমার শ্রেষ্ঠাসহ ৩৯টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা বেগম জিয়ার সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে কুটনীতিকদের সেমাই-জর্দাসহ মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের পাশে দলের স্থায়ী কমিটির সদন্য মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, আসম হান্নান শাহ, জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, সদ্যকারামুক্ত গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, অধ্যাপক আফম ইউসুফ হায়দার, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, আউয়াল ঠাকুর, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, চলচিত্রকার গাজী মাজহরুল আনোয়ার, ছড়াকার আবু সালেহ, কবি মাহমুদ শফিক, কন্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীন প্রমুখ ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে ছিলেন। রাজনীতিবিদের মধ্যে কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, খন্দকার লুৎফর রহমান, জাপা(কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, মুসলিম লীগের এএইচএম কামরুজ্জামান খান, ন্যাপ এর জেবেল রহমান গানি, ন্যাপ-ভাসানীর আজহারুল ইসলাম,সাম্যবাদী দলের সাঈদ আহমেদ, বিজেপি‘র সালাহউদ্দিন প্রকাশ ছিলেন। শুভেচছা বিনিময়ের এই অনুষ্ঠানে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আবদুল মান্নান, শাহজাহান ওমর, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আবদুল হালিম, সুজাউদ্দিন, ইসমাইল জবিউল্লাহ, রুহুল আলম চৌধুরী, মাহবুবউদ্দিন খোকন, ফজলুল হক মিলন, জিয়াউর রহমান খান, আসাদুজ্জামান রিপন, এস এম ফজলুল হক, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, খায়রুল কবীর খোকন, নাজিমউদ্দিন আলম, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, তৈমুর আলম খন্দকার, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু তাবিথ আউয়াল ও চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ছিলেন। অঙ্গসংগঠনের নেতা যাদের অনেকে আত্মগোপেনে আছে, তাদের মধ্যে হাবিব উন নবী খান সোহেল, মীর সরফত আলী সপু, শফিউল বারী বাবু, সাইফুল আলম নিরবও এই অনুষ্ঠানে আসেন। অঙ্গসংগঠনের নেতাদের আনোয়ার হোসেন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মুনির হোসেন, এম এ মালেক, আবু তাহের, তকদির হোসেন মো. জসিম, নুরে আরা সাফা, শিরিন সুলতানা, হাফেজ আবদুল মালেক, শামা ওবায়েদ, আকরামুল হাসানসহ বিভিন্ন স্তরের নেতারা দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পেশাজীবীদের নেতাদের মধ্যে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক রুহুল আমিন গাজী, ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের আনহ আখতার হোসেন, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের শওকত মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আবদুল হাই শিকদার, শিক্ষক-কর্মচারি ঐক্যজোটের জাকির হোসেন প্রমূখ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
জিয়ার কবর জিয়ারতঃ
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিয়ম শেষে খালেদা জিয়া শেরে বাংলা নগরে প্রয়াত স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে পুস্পমাল্য অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন।
এ সময়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ারসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন।
আরাফাত রহমান কোকো‘র কবর জিয়ারতঃ
পরে বেগম জিয়া বনানী কবরাস্থানে তার ছোট আরাফাত রহমান কোকো‘র কবর জিয়ারত করেন। এ সময়ে কোকো‘র প দুই মেয়ে জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানকে তার পাশে ছিলো। পরে তিনি দুই নাতনিকে গাড়িতে নিয়ে গুলশানের বাসায় চলে যান।