ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক নীতিনির্ধারণী গবেষণার মুখপত্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ ম্যাগাজিনের বাংলাদেশ বিষয়ক এক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেশটিতে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ম্যাগাজিনের ৩রা আগস্ট সংখ্যায় ‘উইল আইসিস ইনফেক্ট ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই বিশ্লেষণে ‘এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সাফল্যজনকভাবে আইএস-এর অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে’ উল্লেখ করে ‘কিন্তু এতকিছুর পরও ভবিষ্যতে দেশটিতে আইএস-এর প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিতে সদা সতর্ক ও এদের প্রতিরোধে তৎপর থাকতে হবে’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
ওই বিশ্লেষণে বলা হয়, বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। কেবলমাত্র অধিকতর শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধশালী এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল পরিবেশই দেশটিতে উগ্রবাদের ঝুঁকিকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশে দুর্নীতির উৎস নিয়ে গবেষণারত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আতিফ জালাল আহমদ এবং ওয়াশিংটন ডিসি’র বিখ্যাত থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্কলার-এর এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট মাইকেল কুগেলম্যান-এর যৌথ রচনায় প্রকাশিত ওই বিশ্লেষণে বলা হয়, বাংলাদেশের বিরাট মুসলিম জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্যে জাতির কাছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন অনেক বেশি গুরুত্ববহ। যেসব সমস্যা বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা ও যথেচ্ছ দুর্নীতি। এসব অর্থনৈতিক আধুনিকায়নের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়। ভবিষ্যৎ নীতির ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে অর্থনৈতিক সংস্কারের গতি হ্রাস। ফলে ভবিষ্যতে একই উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে কি-না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।
ওই বিশ্লেষণী প্রবন্ধে ‘আইএসের বৈশ্বিক বিস্তার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে’ বলে উল্লেখ করে বলা হয় ‘যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় দক্ষিণ এশিয়া এই জঙ্গি সংগঠনটির সর্বশেষ ফ্রন্ট হতে পারে।’ বিশ্লেষণের শুরুতে বলা হয়, তিউনিসিয়ার সমুদ্রসৈকতে সাম্প্রতিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ইসলামী স্টেট (আইএস) অনুগত জঙ্গিদের হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই জঙ্গি সংগঠনটির থাবা বিশ্বে কোন পর্যন্ত বিস্তৃৃত হতে পারে সে ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর কিছু তালেবান সদস্য আইএসে যোগ দিতে পারে বলে সতর্ক করা হয়।
এতে আফগানিস্তানে এই জঙ্গি সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়। ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের মতে দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদী উপদল ইতিমধ্যেই আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে।
এসব গ্রুপের মধ্যে রয়েছে: পাকিস্তান তালেবানের (টিটিপি) দলত্যাগী উপদল, উজবেকিস্তানের তেহরিক-ই-খিলাফত ও ইসলামী আন্দোলন। এই দুটি সংগঠনই আবার পাকিস্তানে থেকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এ ছাড়াও রয়েছে আফগানিস্তানের ইসলামী ব্রিগেড ইন খোরাসান ও আল-তাওহিদ ব্রিগেড ইন খোরাসান এবং ভারতভিত্তিক আনসার-আল-তাওহিদ।’
ওই প্রবন্ধে আরও বলা হয়, আইএস সমর্থক গ্রুপ যখন এক বছর আগে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সংগঠনটির বিস্তারিত পাঁচ বছরমেয়াদি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ম্যাপসহ তুলে ধরে, তখনই সংগঠনটি বিশ্বব্যাপী তাদের থাবা যে প্রসারিত করতে চায়, সেটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। তাদের স্বঘোষিত খিলাফতের আওতায় অনেক দেশকেই আনা হয়েছে। এটা গ্রাফিকস অঙ্কনে দৃশ্যমান। বিশ্লেষকদ্বয় বলছেন, বাংলাদেশকে এই তালিকায় বাদ রাখা হয়েছে। আর এই বাদ দেয়ার বিষয়টি কতগুলো কারণে ‘বিস্ময়কর’ বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
তাদের মতে, প্রথমত, বাংলাদেশী উৎসের অনেক ইউরোপীয় অধিবাসী আইএসকে ভাড়াটিয়া যোদ্ধা দিয়ে সাহায্য করেছে। বাড়তি হিসেবে রয়েছে দেশটির পরিস্থিতি অস্থিতিশীল, এখানে রয়েছে অব্যাহত রাজনৈতিক বিরোধ ও সমাজে রয়েছে কিছু উগ্রবাদী উপাদান। এটা দেশটিকে যথেষ্ট ভঙ্গুর করেছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যখন আইএসের প্রভাব বৃদ্ধির পাচ্ছে, তখন এটা সুখকর নয়। তারপরও বাংলাদেশ কীভাবে আইএস ম্যাপ থেকে বাদ যেতে পারল?’
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনার একটি বক্তব্য-‘একটি মধ্যপন্থি, সহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম জনবহুল দেশ ও তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেটি বিশ্বের ঝামেলাপূর্ণ অঞ্চলে সহিংস উগ্রবাদের মধ্যে টিকে থাকতে সক্ষম একটি বিকল্প’ উদ্ধৃত করে বলা হয় ‘সর্বজনস্বীকৃতভাবে এখানে উগ্রবাদী সহিংসতার আলামত থাকার পরও রাষ্ট্রদূত মজীনা যথার্থভাবেই বাংলাদেশকে একটি মধ্যপন্থি, সহিষ্ণু দেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।’
ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট-এর মতে বাংলাদেশে চলমান আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা ও যথেচ্ছ দুর্নীতির মতো প্রবণতাগুলো দেশটির অর্থনৈতিক আধুনিকায়নের ভিত্তিকে দুর্বল করছে। এ ছাড়া ভবিষ্যৎ নীতির ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্যের অভাবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের গতি হ্রাস পেয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে একই উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে কি-না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।’
ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট-এর গবেষণাধর্মী ওই বিশ্লেষণে আরও বলা হয় যে, ২০০৫ সালের ১৭ই মার্চের মতো বাংলাদেশে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। বর্তমান সরকার উগ্রবাদমুক্তকরণ প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে এবং ইসলামী জঙ্গিদের রাশ টেনে ধরার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। জঙ্গিদের ছোট ছোট প্রশিক্ষণ শিবির আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে, বিদেশি উগ্রবাদীরা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টার সময় আটকে দেয়া হচ্ছে। জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আটক করা হয়েছে। এতে কার্যকরভাবেই জঙ্গি সংগঠনটিকে বিলুপ্তির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাদের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
২০১৩ সালের ২২শে অক্টোবর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতা উদ্যোগে স্বাক্ষর করে। ফলে মার্কিন বিশেষজ্ঞ সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক মান অর্জনে সহায়ক হয়।’ গবেষকদ্বয়ের মতে, উগ্রবাদী সহিংসতার মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশে মৌলবাদ প্রতিফলিত হয় না, জামায়াতে ইসলামী (জেআই)-এর মতো সংগঠনের রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমেও তা প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের ৩শ’ আসনের সংসদে এই দল জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
জেআই ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ১৮টি আসন লাভ করে, ১৯৯৬ সালে লাভ করে তিনটি আসন, ২০০১ সালে পায় ১৪টি এবং ২০০৮ সালে পায় দুটি আসন। তবে জেআইর আল্লাহর আইনের ওপর পরিপূর্ণ আস্থা প্রকাশ বাংলাভাইয়ের মতো জঙ্গিদের সমর্থন পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নারী নেতৃত্ব মেনে নেওয়াকে এসব জঙ্গি নেতা প্রত্যাখ্যান করেন।
বস্তুত বাংলাভাই জেআইর আদর্শকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। তারা সহিংসতা ও ধ্বংসের পথ গ্রহণ করে। সৌভাগ্য যে, তাদের অপতৎপরতা বেশি দিন টেকেনি। আজ জেআইও নিঃশেষ হওয়ার পথে। তাদের বিপুল সংখ্যক ক্যাডার আটক হয়ে কারান্তরীণ রয়েছে।’
‘আইএসের পক্ষে সেন্টিমেন্ট বাংলাদেশে অত্যন্ত দুর্বল। আইএসের পক্ষে টুইটিং দেশের তালিকায় কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই’- উল্লেখ করে ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট-এর বিশ্লেষণে বলা হয়, ইসলামী উগ্রবাদী আদর্শ বহুলাংশে বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশটির মুসলিম জনগণ সাধারণত মধ্যপন্থি ও সহিষ্ণু। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যপন্থি ও সহিষ্ণু অবস্থার প্রমাণ হলো মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা একে অপরের পূজা, ঈদ, ক্রিসমাস ও বুদ্ধপূর্ণিমার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলো একসঙ্গে উদযাপন করে। গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবে জাতীয় ছুটি থাকে, যাতে ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সবাই তাতে অংশ নিতে পারে।’
ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট-এর মতে, কিন্তু এত কিছুর পরও অলক্ষুণে কথা হলো, তারপরও বাংলাদেশ একদিন আইএস প্রভাবের মধ্যে পড়তে পারে মর্মে সতর্কবার্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। অধিকতর শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধশালী ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল পরিবেশই উগ্রবাদের ঝুঁকিকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে পারে।’