ডকট্রিন অব নেসেসিটি নিয়ে কিছু বলার আগে একটি গল্প বলে নিই। কুমিরের খাঁজকাটা লেজের গল্পটি বোধকরি অনেকেরই জানা। এক স্কুলছাত্রকে তার শিক্ষক ‘কুমির’-এর ওপর রচনা লিখতে বললেন। ছাত্রটি লিখল, ‘কুমির একটি উভচর প্রাণী। তবে এটি সাধারণত নদীতে বাস করে। এর একটি লম্বা মাথা, দুটি চোখ এবং একটি লম্বা লেজ আছে। কুমিরের লেজ খাঁজকাটা, খাঁজকাটা, খাঁজকাটা, খাঁজকাটা…।’ খাঁজকাটার অতি ব্যবহারে শিক্ষক বিরক্ত হলেন। এবার ছাত্রকে নির্দেশ দিলেন গরুর রচনা লিখতে।
এবার সে লিখল, ‘গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী। এর চারটি পা, দুটি কান, একটি মাথা, দুটি চোখ ও একটি লেজ আছে। গরু ঘাস খায়। পিপাসা পেলে গরু নদীতে নেমে পানি পান করে। নদীতে কুমির থাকে। কুমিরের লেজ খাঁজকাটা, খাঁজকাটা, খাঁজকাটা…।’
শিক্ষক প্রমাদ গুনলেন, সবকিছুতে খাঁজকাটা। একে তো শায়েস্তা করতে হয়। এবার রচনা লিখতে দিলেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলা। আর মনে মনে ভাবলেন, এবার বাছাধন তোমার খাঁজকাটা রোগের অবসান হবেই। কিন্তু শিক্ষককে তাজ্জব করে দিয়ে ছাত্র রচনা লিখল, ‘বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নবাব আলীবর্দী খাঁর দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেনাপতি হিসেবে মীর জাফরকে বহাল রেখে খাল কেটে কুমির আনলেন। কুমির নদীতে বাস করে। তার লেজ খাঁজকাটা, খাঁজকাটা, খাঁজকাটা…।’
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আজ সেই খাঁজকাটা রোগে চরমভাবে আক্রান্ত। তাদের খাঁজকাটা আগে ছিল একটি— যুদ্ধাপরাধের বিচার। এখন আরেকটি বেড়েছে— সংবিধান। এ দুটি খাঁজকাটার দোহাই দিয়ে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন।
যত জনদাবি, যত প্রতিবাদ, সবকিছুর জবাবে ক্ষমতাসীনদের মুখে একটি বুলিই শোনা যায়— যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র। রেলওয়ের কালোবিড়াল নগদ সমেত ধৃত , সেটাও যুদ্ধাপরাধ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র।
কুইক রেন্টালের মাধ্যমে কুইক দুর্নীতির পথ প্রশস্ত হলো। শেয়ারবাজার থেকে লক্ষ-কোটি টাকা লুট করে সর্বস্বান্ত করা হলো লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। দুর্নীতির মহোত্সব চলতেই থাকলো ।
পদ্মা সেতু ও অপরাপর বড় বড় দুর্নীতির কারণে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও কলঙ্কিত হলো বাংলাদেশ। হলমার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, টাকার বস্তাসহ মন্ত্রীর ধরা পড়াসহ নজিরবিহীন সব দুর্নীতির ঘটনা ঘটে চলছে অব্যাহত গতিতে।
অন্যদিকে চলছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বেপরোয়া সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজি। এসব কিছুর প্রতিবাদ হলে সেটা হয়ে যায় যুদ্ধাপরাধ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র !
প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের প্রাণের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, নাকি যুদ্ধাপরাধ বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র !
সরকারের এ হাস্যকর প্রতিক্রিয়ায় অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তাদেরই সৃষ্ট প্রায় দুই ডজন মিডিয়া, যে মিডিয়াগুলোর বক্তব্য সেসব মিডিয়াসংশ্লিষ্ট লোকেরাই বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ ।
গণমাধ্যম না হয়ে তারা হয়ে পড়ছে সরকারমাধ্যম। এসব হলুদ মিডিয়ার নিউজমেকিংয়ে পাঠকরা সত্যিকার অর্থে কোনো খবর পায় না কিঞ্চিত্ বিনোদন ছাড়া।
সংবিধানকে কেটে-মুছে নিজেদের অনুকূলে নেয়ার পর দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের অতিমাত্রায় সংবিধানপ্রীতি বেশ লক্ষণীয়। এরই মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এই প্রহসনের নির্বাচন জনগণের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে।
কেউ কেউ এটাকে বিয়ের আগেই কনের বাচ্চা প্রসবের সঙ্গে কিংবা বাবাবিহীন সন্তানের সঙ্গে তুলনা করছেন। নির্বাচন নয়, যেন বানরের পিঠাভাগ। প্রধানমন্ত্রী এক ধাপ এগিয়ে বললেন, নির্বাচনে এলে বিএনপির সঙ্গেও সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি হতো এভাবে।
সেলুকাস! এটা নাকি জনগণের ভোটাধিকার ! ২৮ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫ই জানুয়ারীর পাতানো নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলো । ইইউর পদক্ষেপকে যুদ্ধাপরাধের পক্ষ নেয়া হিসেবে আখ্যা দিতে দেরি করেননি প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়। তামাম বিশ্বসম্প্রদায়কে সরকার যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে ছেড়েছিলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই অভিনব সংসদ নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে ,৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন টি ছিলো সংবিধানের ধারাবাহিকতার নির্বাচন,সত্যিই কি তাই ?
প্রশ্ন হচ্ছে, ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কি সংবিধান মেনে নির্ধারিত সময়ে হয়েছিল? ওয়ান-ইলেভেনের অভিনব সরকার কি সাংবিধানিক সরকার ছিল ?
এক কথায় উত্তর—না। ওয়ান-ইলেভেনের পর সদ্য নিয়োগ পাওয়া সিইসি এটিএম শামসুল হুদা এক অভিনব তত্ত্বের কথা হাজির করলেন।
ঘোষণা করলেন— সংবিধান নয়, ডকট্রিন অব নেসেসিটি অনুযায়ী হবে নির্বাচন। তাই ঘটল। অসাংবিধানিক সরকারের অধীন সংবিধান লঙ্ঘিত নির্বাচনে ভূমিধস (??) জয় পেয়ে সরকার গঠন করে বর্তমানের ক্ষমতাসীন সরকার।
বাংলাদেশের জন্য ডকট্রিন অব নেসেসিটির প্রয়োগ নতুন হলেও বিশ্ব রাজনীতিতে এটি একেবারে বিরল নয়।
১৯৫৪ সালে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ মুনীর গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহাম্মদের সংবিধানবহির্ভূত জরুরি ক্ষমতাকে বৈধতা দান করতে এর প্রয়োগ ঘটান।
১৯৮৫ সালে ডকট্রিন অব নেসেসিটির দ্বিতীয় প্রয়োগ হয় গ্রানাডায়। এরপর ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশে এর একাধিক প্রয়োগ হয়।
উপসংহারে পৌঁছানোর আগে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন রাখতে চাই।
২০০৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে কেন আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি ?
অভিযোগ করা হয়েছিল— বিচারপতি কে এম হাসান ছাত্র জীবনে ছিলেন বিএনপিপন্থী।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো শুধু আওয়ামীপন্থীই নন, আপনি খোদ আওয়ামী লীগের প্রধান। কোন ভরসায় এখন বিএনপি আপনার অধীনে নির্বাচনে যাবে?
এমন মেরুদণ্ডহীন দলকানা বর্তমান ইসির উদাহরণ সারা বিশ্বে কি আর একটিও আছে? সংবিধান তো ঐশী বাণী নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। এ পর্যন্ত ১৫ বার সংশোধিত হয়েছে। তাহলে জনগণের চাওয়া অনুযায়ী ষোড়শ সংশোধনী করা যাবে না কেন?
নির্দলীয় সরকারের দাবি অসাংবিধানিক বলে সরকার প্রত্যাখ্যান করছে। কিন্তু সরকারের গঠিত সর্বদলীয় সরকার (নাকি একদলীয়) কি আদৌ সাংবিধানিক?
যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করে সেটাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করেছিল, নির্বাচনকালীন সে সরকার ব্যবস্থার প্রতি সরকারের এখন এত অনীহা কেন?
আদৌ কি সরকার সংবিধান মানছে? ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ নিয়ে যেটা করা হয়েছে , সেটা কি সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন নয়?
প্রয়োজন আইন মানে না। মূলত : Necessity knows no law.’ — এ ধারণা থেকেই Doctrine of Necessity-এর উত্পত্তি। Wikipedia-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী : The Doctrine of Necessity is the basis on which extra-legal actions by state actors, which are designed to restore order, are found to be constitutional.
বর্তমান পরিস্থিতি যে পর্যায়ে সেক্ষেত্রে ডকট্রিন অব নেসেসিটিই দিতে পারে সমাধান। একতরফা ভোটারবিহীন হাস্যকর নির্বাচনের কলঙ্ক থেকে জাতি মুক্তি চায়, জনগণ সত্যিকার ভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। দেশের প্রায় প্রতিটি নাগরিক চায় সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। প্রয়োজন দলগুলোর মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা।
অবিলম্বে আলোচনার মাধ্যমে মধ্যবর্তি নির্বাচন দিন । এটি আজ সময়ের দাবি। সংবিধানের টাইমফ্রেম নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও ডকট্রিন অব নেসেসিটির আওতায় হোক । দেশে আবার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।