ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য সহযোগিতা আমরা চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরন করবো।তারপরেও এই যুদ্ধে ভারতের কৌশলগত অবস্থান বিশ্লেষন করলে কিছু বিষয়ের অবতারনা না করলেই নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে,ভারত কবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় ??
উত্তরটি হলোঃ ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর থেকে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বলে সকল নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায় ।
মজার ব্যাপার হল ওই সময়ের মধ্যে আমাদের বীর মুক্তি বাহিনী দেশের ৯৫-৯৯ শতাংশ অঞ্চল শত্রুমুক্ত করে ফেলেছিল । যদিও শুরু থেকেই ভারত আমাদের বিপুল সংখ্যক (প্রায় ১ কোটি) শরনার্থীদের আশ্রয় দেয়া ,মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও ট্রেনিং দেয়া সহ প্রভূত সহায়তা দিলেও পাকিস্থানের বিরুদ্ধে ৩রা ডিসেম্বর'৭১ এর আগে সরাসরি যু্দ্ধে লিপ্ত হয় নি কেনো ??
ভারত কেন আরো আগে রনাঙ্গণে এলো নাঃ
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অংশ গ্রহন কতটা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করার অভিপ্রায়ে ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। কারন আগেই বলেছি যে ভারত যখন রণাঙ্গনে আসে তখন আমাদের দেশের ৯৫-৯৯ শতাংশ অঞ্চলই মুক্ত হয়ে গিয়েছিল আমাদের মুক্তি বানহিনীর বীরত্বে।
তাহলে কি কারনে আমাদের কৃতিত্বে ভাগ বসানোর জন্য শেষ মুহুর্তে ভারতের আগমন? মূল কারনগুলো নীচে পয়েন্ট আকারে বলছিঃ
পাক -ভারতের আজন্ম দ্বন্দের একটা স্ফুরণ ঘটেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানের বিরূদ্ধে লড়ার জন্য ভারত বিভিন্ন ভাবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছিল। ওই সময় পাকিস্তান ভারতের বিরূদ্ধে "অপারেশন চেঙ্গিস খান" নামক একটি আক্রমণ চালায় যা ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ইন্দো-পাক যুদ্ধের সূচনা করে।
ওই যুদ্ধে জয় লাভের জন্য বাংলাদেশের চলমান স্বাধীনতা যুদ্ধকে ব্যবহার করার খুব সুক্ষ বুদ্ধি এঁটেছিলো ভারত। কারন ভারত জানত যে পাকিস্তানকে ইন্দো-পাক যুদ্ধে পরাজিত করার সবচেয়ে ভালো উপায় হল দ্বিমুখী আক্রমণে পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করা। এই জন্যই ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করার নামে সৈন্য পাঠায় ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ এ !!
যাতে করে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারে। এভাবে একদিকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার সব কৃতিত্ব ভারত নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয় আবার বাংলাদেশের সাহায্য নিয়ে ইন্দো-পাক যুদ্ধে ভারত সহজে জয় লাভ করে যা বাংলাদেশের সাহায্য ব্যতিরেকে ভারত কখনোই পারতো না । তাহলে কে কাকে সাহায্য করেছিলো ১৯৭১ এ ? বোধ করি উত্তরটা এখন আর আপনাদেরকে বলে দিতে হবে না।
— বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় যে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রশিক্ষণ, খাদ্য সরবরাহ ইত্যাদি বাবদ ভারত সরকারের ব্যয় হয় আনুমানিক ৭০০ কোটি টাকা। আর যে অস্ত্রশস্ত্র ভারত আমাদের দিয়েছিল বলে আমরা জানি তা কিন্তু প্রকৃত পক্ষে রাশিয়া উপহার হিসেবে আমাদের দিয়েছিলো ভারতের মাধ্যমে। ওইসব সাহায্যের বিনিময়ে ভারত আমাদের সাথে কি করেছিল জানেন?
তারা ১৬ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ জুড়ে নজির বিহীন লুটপাট চালিয়েছিলো। পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র যার মূল্য ওই সময় ছিলো ২৭শ কোটি টাকা তার সবই ভারত ১৫ টি বিশাল জাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে লুট করে নিয়ে যায়। অথচ সেই অস্ত্রের মালিকানা ছিলো পুরোপুরি বাংলাদেশের । শুধু তাই নয় বাংলাদেশের শত শত মিল কারখানার যন্ত্রপাতি, ব্যাংক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যাল, ঘর বাড়ির সাধারণ গৃহস্থালী জিনিসপত্র পর্যন্ত বাদ যায়নি লোভী ভারতীয় লুটেরাদের হাত থেকে।
এসব সম্পদ ও দ্রব্যাদির তখনকার মূল্য ছিলো আনুমানিক ৯ হাজার কোটি টাকা। এমনও শোনা যায় যে শৌচাগারের বদনা গুলোও বাদ দেয়নি ভারতীয় লুটেরার দল। এছাড়াও যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রদত্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্যও লুট করে নিয়ে যায় আমাদের পরম মিত্র (!!!) ভারত।উল্লেখ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাটে বাধা দিয়ে অপমানজনক ভাবে চাকুরী চ্যুত হন আমাদের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল এবং এই কারনে তাকে কোন বিরত্ব সূচক খেতাব ও দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার ।
— ভারতের আরেকটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে দ্বিমুখী সুবিধা আদায় করা। প্রথমতঃ সেই সময় বিশ্বের অন্যতম বড় মুসলিম প্রধান অঞ্চল বাংলাদেশ (সে সময়ের পুর্ব-পাকিস্তান) ও পাকিস্তান (সে সময়ের পশ্চিম-পাকিস্তান) যদি এক দেশ হিসেবে গন্য হত তাহলে সেটা ভারতের জন্য অনেক বড় একটি হুমকি হিসেবে দেখা দিত যা সামাল দেয়ার ক্ষমতা ভারতের ছিলো না।
কারণ ভৌগলিক ভাবে তাদের দুইদিক থাকত শত্রু পরিবেষ্টিত। দ্বিতীয়তঃ ভারত চেয়েছিলো পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও অন্যান্য সকল দিক দিয়ে শোষণ করে কার্যতঃ ধ্বংস করে দিতে। আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪০ বছরে ভারত আমাদেরকে উল্লেখিত উপায়ে শোষণ করে গেছে আর দিন দিন এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে।
খেয়াল করে দেখুন বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আচরণ দেখে মনে হয় যে এই দেশ ভারতের কোন অঙ্গরাজ্য। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যদি এই দেশ প্রকৃতই ভারতের কোন অঙ্গরাজ্য হত তাহলে কিন্তু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের দায়িত্বও ভারতের উপরে বর্তাতো। কিন্তু যেখানে কোন দায়িত্ব না নিয়েই ভারত আমাদের দেশ থেকে সব ধরনের সুবিধা আদায় করে নিতে পারছে সেখানে নিজের অঙ্গরাজ্য বানিয়ে অতিরিক্ত ১৬ কোটি মানুষের বোঝা নেয়ার মত বোকামী ভারতের মত কুটবুদ্ধি সম্পন্ন দেশ কেন করবে? সম্ভবতঃ একারনেই ভৌগলিক ভাবে এখনো বাংলাদেশ কে দখল করে নেয়নি বন্ধুরূপী শত্রু ভারত।
সন্মানিত পাঠকগণ, আমি আমার এই লেখা আর দীর্ঘায়িত করব না। পরিশেষে আমাদের স্বাধীনতা যদ্ধের মহান সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী তথা বাংলাদেশের লাখো-কোটি স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরদের প্রতি ভারতের ভয়ানক অবহেলা আর অপমানের আরেকটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর উদাহরণ টেনে আমার লেখা শেষ করবঃ
আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন যে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় ক্ষণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর জগজিত সিং আরোরার কাছে। কিন্তু তার আত্মসমর্পণ করার কথা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মহান সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীর কাছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য জেনারেল ওসমানীকে ওই আত্মসমর্পন অনুষ্টানে উপস্থিত থাকতেই দেয়া হয়নি। সুচতুর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ অতি সুক্ষ এক চাল চেলে আমাদের পুরো জাতিকে এই বিরল প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে নিজেরা সেই গৌরব লুন্ঠন করেছিল। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জেনেছি যে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য ওইদিন জেনারেল ওসমানী একটি হেলিকপ্টারযোগে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ রবকে সাথে নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন।
কিন্তু ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয় যার ফলে গুলি বিদ্ধ হন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রব এবং হেলিকপ্টারটির তেলের ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে যাওয়া সহ আরো বিপুল ক্ষতি হয়। ওই অবস্থায় হেলিকপ্টারটি সাথে সাথে একটি মাঠে জরুরী অবতরণে বাধ্য হয় এবং পন্ড হয়ে যায় জেনারেল ওসমানীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার স্বপ্ন, ধ্বংস হয়ে যায় নিয়াজী তথা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন দেশের আপামর জনসাধারণকে আরেকবার গৌরবান্বিত করতে জেনারেল ওসমানীর স্বপ্ন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ওই সময় ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকা ছিল সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত আর হেলিকপ্টারটি জরুরী অবতরণ করার প্রায় সাথে সাথেই ভারতীয় এক কর্নেল ২ টি এম্বুলেন্স নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। এত দ্রুত কিভাবে ভারতীয় সেই কর্নেল ঘটনাস্থলে পৌছালেন এই প্রশ্নের উত্তর বুঝে নিতে খুব বড় সমঝদার হতে হয় না।
মুল কথা হল ভারত সুকৌশলে পাকিস্তানকে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করানোর মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমাদের স্বাধীনতার গৌরব লুন্ঠন করে নিয়েছিল আমাদেরই বিজয় দিবসে। দুঃখজনক হলেও সত্যি সেদিন এতবড় এক অন্যায় আর অসঙ্গতির বিরূদ্ধে খুব বেশী মানুষ প্রতিবাদ করেননি আর জেনারেল ওসমানীর সেই হত্যা চেষ্টার রহস্য উদ্ঘাটনের কোন পদক্ষেপও কেঊ গ্রহন করেননি।
এমনকি ৯৭০০০ পরাজিত যুদ্ধবন্দী পাকিস্থানী সৈন্যদের ভারত নিজ সিদ্ধান্তে ভারতে নিয়ে যায় এবং কাশ্মির সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন অমিমংসিত ইস্যুসমূহ মিমাংসায় ভারতের দরকষাকষির ট্রামকার্ড হিসাবে ব্যাবহার করে এবং ফলশ্রুতিতে ইন্দিরা-ভূট্টোর মাঝে সম্পাদিত হয় সিমলা চুক্তি যা অনুযায়ী পাকিস্থানী যুদ্ধবন্দী সেনারা স্বদেশে অক্ষত অবস্থায় ফেরৎ যায়।
অথচ পাকিস্থান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের এই সৈনদল ছিলো ইতিহাসের অন্যতম জগন্য গনহত্যার দায়ে অভিযুক্ত । তাদের ভয়াবহ কর্মকান্ডে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানে ৩০লক্ষ মানুষ শহীদ হন,২ লক্ষের বেশী মা-বোন হারান তাদের সম্ভ্রম,এ অঞ্চল পরিনত ধংসস্তুপে ।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সিমলা চুক্তি তে বাংলাদেশ কে অন্তর্ভূক্ত করা হয় নি এবং আমাদের তৎকালীন মিত্রদেশ ভারত বাংলাদেশের নায্য সম্পদ ফেরৎ (প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা) ,পশ্চিম পাকিস্থানে আটকে পড়া প্রায় লক্ষাধিক বাংলাদেশীর ভাগ্য নির্ধারন সর্বপরি পাকিস্থানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কোন কথাই বলেনি ।
ভারতের ইতিহাস এবং পাঠ্য বইসমূহে ১৯৭১ সালের ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে এবং যে যুদ্ধে পাকিস্থান পরাজিত হয়ে ভারতের কাছে আত্মসমর্পন করেছিলো।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোন গৌরবগাথা ভারতের নতূন প্রজন্মকে কখনও জানতে দেয়া হয় না,কেনো??
এভাবেই ভারত আমাদের দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে দিয়েছিল ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর আর সেই শৃঙ্খল থেকে আজো আমরা মুক্ত হতে পারিনি । পাকিস্থানের নাগপাশ থকে মুক্ত হয়ে আমরা ভারতের নাগপাশে বন্দি হতে চাইনি । তাই মনে করি আমাদের আবারো জেগে ওঠার সময় হয়েছে……আসুন জেগে উঠি আরেকবার……ধন্যবাদ।