মেজর জেনারেল(অবঃ)এএলএম ফজলুর রহমানঃ সেই দিনের ভোরটিও ছিল আর অন্যান্য দিনের মতোই। রৌমারী সীমান্তে বড়াইবাড়ি গ্রামের জনগণ তখনো ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেনি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এখানে কী ভীষণ তাণ্ডব শুরু হবে।
বিডিআর ও বিএসএফের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলিতে গ্রামবাসী হতচকিত হয়ে ওঠে। প্রাণভয়ে তারা পালিয়ে যায় নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত বড়াইবাড়িসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতে ফিরে আসতে সাহস পাননি।
বড়াইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বুধবার ১৮ এপ্রিল ভোর রাতে যারা ক্ষেতের কাজে মাঠে নেমেছিল, গ্রামের চারপাশে কয়েকশ বিএসএফ জওয়ানের উপস্থিতি তাদের স্তম্ভিত করে দেয়।
এ সময় বিএসএফ জওয়ানদের সামনে গ্রামবাসীর যারাই পড়েছে সবাইকেই তারা ‘হট যাও’ বলে তাড়িয়ে দেয়। গ্রামের অধিবাসী আব্দুল কাদের মেম্বারের ছেলে শাখাওয়াত (১৮) এ সময় বাড়ির পাশের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য পাম্প চালু করতে ক্ষেতে গিয়েছিল।
সেখানেই কয়েকজন বিএসএফ জওয়ান তার পথরোধ করে হিন্দিতে বিডিআর ক্যাম্পটি কোথায় তা জানতে চায়। ঘুম থেকে উঠে অকস্মাৎ এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে ভয় পেলেও বুদ্ধি হারায়নি শাখাওয়াত। সে বুঝতে পারে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে আসা বিএসএফ সদস্যদের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই শুভ হতে পারে না।
এই পরিস্থিতিতে সে বিএসএফ জওয়ানদের বিডিআর ক্যাম্পের সঠিক অবস্থান না দেখিয়ে গ্রামের অন্য একটি বাড়ি দেখিয়ে দেয়। এরপর বিএসএফ তাকে ছেড়ে দিলে শাখাওয়াত বাড়ি ফিরে এসে সবাইকে ঘটনাটি খুলে বলে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে কাদের মেম্বার তখনি বাংলাদেশ সীমানায় বিএসএফের প্রবেশ এবং তারা যে বিডিআর ক্যাম্পটি খুঁজছে সেই সংবাদ বিডিআর ক্যাম্পে লোক মারফত পৌঁছে দেয়।
বিডিআর সদস্যরা প্রথমে ঘটনাটি পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও তারা দ্রুত প্রস্তুত হয়ে পড়ে। এই সময় বিএসএফ শাখাওয়াতের দেখিয়ে দেওয়া ভুল বাড়িটিকে বিডিআর ক্যাম্প ভেবে সেটি লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
এই গুলির শব্দে বিডিআর জওয়ানরা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারে। বিএসএফের তুলনায় সংখ্যায় নিতান্ত নগণ্য হওয়ায় জান বাঁচানোর তাগিদে প্রথম চোটেই তারা বিএসএফের অবস্থান লক্ষ্য করে মেশিনগানে ব্রাশফায়ার করে।
বিডিআরের পক্ষ থেকে পাল্টা হামলার জন্য বিএসএফ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বিএসএফের লক্ষ্য ছিল ভোর রাতে অতর্কিতে বিডিআর ক্যাম্পে হামলা করে ক্যাম্পের দখল নেওয়া।
ফলে হঠাৎ করে বিডিআরের এই পাল্টা জবাবে তারা হতচকিত হয়ে পড়ে। প্রথম চোটেই মারা পড়ে বেশ কয়েকজন বিএসএফ সদস্য। বিডিআরের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় বিএসএফ । এ সময় তারা বড়াইবাড়ি গ্রামের পর্বপাশে বিতর্কিত এলাকার গ্রামে আশ্রয় নিয়ে এই এলাকার গ্রামবাসীদের অর্ধশতাধিক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
সেখান থেকেই তারা বিডিআর ক্যাম্প লক্ষ্য করে ক্রমাগত মেশিনগান ও মর্টার শেল চালাতে থাকে । বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ১৬ জন বিএসএফ জওয়ানের লাশ ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে। এই লড়াইয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন বিডিআর জওয়ান কাদের।
পরে বৃস্পতিবার মৃত্যু হয় আরো দুজন বিডিআর সদস্যের। বুধবার সকাল থেকে শুরু হয়ে এই যুদ্ধ চলেছিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। মাঝে মাঝে কিছু সময়ের বিরতি ছাড়া দুপক্ষ থেকেই অবিরাম গুলিবর্ষণ চলে। বৃহস্পতিবার দিনে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়।
জামালপুর, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা থেকে বিডিআরের অতিরিক্ত ফোর্স চলে আসে রৌমারী ক্যাম্পে বৃহস্পতির রাতে বিএসএফের ক্যাম্প থেকে ট্রেসার চালানো হয়। এর আলোতে বড়াইবাড়ির আশপাশের তিন-চার মাইল এলাকা আলোকিত হয়ে ওঠে। আশপাশের গ্রামের আতঙ্কিত জনগণ এই আলো দেখে প্রচণ্ডরকম ভীত হয়ে পড়ে।
আশপাশের সবগুলো গ্রামের মানুষ গিয়ে আশ্রয় নেয় ৫-৬ কিলোমিটার দুরে বহ্মপুত্র নদের তীরে। গ্রামবাসী দাবি করেন, ট্রেসারের আলো জ্বালিয়ে বিএসএফ মুলত তাদের নিহত সদস্যদের লাশ তুলে নিয়ে গেছে। গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে ধানক্ষেত থেকে বিএসএফ ক্যাম্প বরাবর ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চিহ্নও দেখা গেছে।
এদিকে সেই রাতে গ্রাম থেকে একটি ঠেলাগাড়ি খোয়া গেছে বলে স্থানীয় বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম লাল মিয়া জানান। এ তথ্য অনুযায়ী বিএসএফ পক্ষে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবের ১৬ জনের বেশি হতে পারে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লাল মিয়া বলেন, প্রথম রাতে বিএসএফ যখন হামলা চালায় তখন প্রায় ৩০০ জন বিএসএফ জওয়ান সীমান্ত থেকে ৫০০ গজ ভেতরে ঢুকে পুরো গ্রামটি ঘিরে ধরে।
তারা গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে ধরণী নদীর ঢালে এবং উত্তর প্রান্তে বিএসএফের কাকড়িপাড়া ক্যাম্প পর্যন্ত এলাকা কর্ডন করে রাখে। মুলত বিডিআর ক্যাম্পটি দখল করে বড়াইবাড়ি গ্রামের বিতর্কিত এলাকাটির দখল নেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য ছিল বলে গ্রামবাসীর ধারণা।
অাজকের এ দিনে সেদিন অংশ নেওয়া প্রতিটি বীর জওয়ানদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম,শহীদ হওয়া বীরদের অাত্মার মাগফিরাত কামনা করছি,খোদা তাদের জান্নাতের সর্বচ্চ অাসন দান করুন।
লেখকঃসাবেক বিডিআর মহাপরিচালক।