ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ এবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ,শহীদ জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ বললেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এমপি এবং সংসদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল(অবঃ)সুবিদ আলী ভূইয়া।
বুধবার একটি সংসদীয় কমিটির বৈঠকে একথা বলার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন সুবিদ আলী ভূইয়া। তার আওয়ামী লীগে থাকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয় বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক সংসদ সদস্য জানিয়েছেন।
বর্তমান সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া প্রথমবার ১৯৯১-৯৫) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময় তার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) ছিলেন।
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিএনপির মনোনয়ন চেয়েও না পেয়ে ২০০১ সালে কুমিল্লার দাউদকান্দি ((কুমিল্লা-১) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন তিনি।
এরপর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়ে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হন।
নবম সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর এবার দশম সংসদে ফের নির্বাচিত হয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি হন সুবিদ আলী।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমান গত বছর তার বাবাকে বাংলাদেশের ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ বলার পর আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েন। তার বক্তব্য-বিবৃতি প্রচারে পরে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও আসে।
এরপর সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এক প্রকাশনায় জিয়াকে ‘প্রথম রাষ্ট্রপতি’ লেখা হলে তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
বুধবার সংসদ ভবনে সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি নিয়ে আলোচনার মধ্যে সুবিদ আলী ওই বক্তব্য দেন বলে কমিটির একাধিক সদস্য জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বলেন, “সুবিদ আলী ওই কথা বলার পর কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তখন কমিটির সভাপতি শওকত আলীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়।
“অন্য সদস্যরা তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, তিনি (সুবিদ আলী) তো আওয়ামী লীগের আদর্শ ধারণ করেন না। কেবল এমপি হওয়ার সুযোগ নিতে তিনি এই দলে যোগ দিয়েছেন।”
“মুহিবুর রহমান, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, আবদুর রউফ ও নাভানা আক্তার সুবিদ আলীর তীব্র সমালোচনা করেন। তাদের একজন তো বলেই বসেন, ‘আপনি তো জিয়ারই সৈনিক। আপনার আসনে বিএনপির বড় নেতা মোশাররফ হোসেন, তাই আপনি বিএনপির মনোনয়ন পান না। এমপি হওয়ার জন্য আপনি এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন।”
এ বিষয়ে কথা বলতে সুবিদ আলী ভূইয়ার মোবাইলে কল করা হলে প্রথমে তা কেটে দেওয়া হয়। পরে একাধিকবার কল করা হলেও তা ধরেননি তিনি।
বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের কথা স্বীকার করে কমিটির সদস্য সুনামগঞ্জের আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, “আজ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিয়ে আলোচনা ছিল। আমি ইউজিসির চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রকাশিত স্মরণিকাতে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর মতে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কিন্তু ইউজিসি তো এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারে।
“আলোচনার এ পর্যায়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান কিছু বলার আগেই সুবিদ আলী বলে ওঠেন, জিয়াই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। এটা তিনি তার বইতেও লিখেছেন।”
মানিক বলেন, “তখন আমি বলেছি বিএনপি যে সেটেলড ইস্যু নিয়ে বিতর্ক করতে চায়, আপনিও (সুবিদ) যদি সেই একই বিষয় নিয়ে কথা তোলেন তাহলে কী দাঁড়ালো ?”
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সদস্য জানান, সমালোচনার মুখেও সুবিদ আলী তার অবস্থানে অনড় ছিলেন।
মানিক বলেন, “আমি বৈঠকে বলেছি, কিছুদিন আগে আমাদের নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন ছাত্রলীগে শিবির অনুপ্রবেশ করেছে। এখন দেখছি সুবিদ আলীর মতো অনেক সুবিধা সন্ধানী বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনে জামায়াত-শিবিরসহ অন্য মতাদর্শের অনেকেই ঢুকে পড়েছেন। এদের শনাক্ত করা উচিৎ।”
এবিষয়ে কমিটির সভাপতি শওকত আলী বলেন, “সুবিদ আলী ভূইয়ার সঙ্গে অন্য সদস্যদের যে বিতর্ক হয়েছে, সেটা আলোচ্যসূচির বিষয় ছিল না। তাই বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ আলোচনা বাদ দেওয়া হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে সুবিদ আলী ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হন, যেখানে জিয়াউর রহমানও ছিলেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জিয়ার অধীনেই যুদ্ধ করেছিলেন সুবিদ আলী। জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯১-৯৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় তার পিএসও ছিলেন তিনি।
জানা গেছে , ১৯৯৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় বিমান থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে আলোড়ন সৃষ্টির ঘটনায়ও সুবিদ আলীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
তখন ওই অস্ত্র চোরাচালানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘নথিপত্র’ ব্যবহার করা হয়েছিল বলে ভারতের প্রখ্যাত অনুসন্ধানী প্রতিবেদক চন্দন নন্দী লিখেছিলেন।
তার লেখায় বলা হয়, কিম ডেভি নামের এক ডেনিশ নাগরিক বুলগেরিয়া থেকে অস্ত্র পরিবহনের জন্য ওই বিমানটি ব্যবহার করছিলেন। অস্ত্রের চালান আনার জন্য যে ‘এন্ড ইউজার সার্টিফিকেট’ (4021/1/AA/ARMY/ASL (P) 2) তিনি ব্যবহার করছিলেন, তাতে মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়ার সই ছিল।