জাহিদ এফ সরদার সাদীঃ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়াতে সম্ভাব্য একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর তা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে সামনে রেখে সম্ভাব্য চুক্তিকে আলোচনায় নিয়েই অনেকে এ নিয়ে উদ্বেগও ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনীতিক মহল অবশ্য এই প্রস্তাবিত চুক্তির বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কিছুই বলছে না।
তবে দুই দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এটা বোঝা যাচ্ছে যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি দিল্লিতে দুই সরকার প্রধানের শীর্ষ বৈঠকে আলোচিত হবে। আর এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও সই হতে পারে।
প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় কী রয়েছে, সেটি নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিক ও বিশ্লেষক সুবীর ভৌমিকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন বিবিসির সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ। ভৌমিক এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর করেছেন।
ভৌমিক বলেন, ‘সামরিক ক্ষেত্রে আরো বাড়তি যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি – এসব ব্যাপারে দু’দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা সেটা একটা ব্যাপার।
দু’নম্বর হচ্ছে, ভারত চাইছে যে ভারতের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র কেনা হোক।’ ‘বর্তমানে বাংলাদেশে বেশিরভাগ অস্ত্র চীন থেকে কেনে – ভারত সেই জায়গাতে ঢুকতে চাইছে।
আর তিন নম্বর যেটা সেটা হচ্ছে, কিছু কিছু সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যৌথ অভিযান বা সম্মিলিত অভিযান চালানো – সেরকম একটা সুযোগ তৈরি করার একটা ব্যাপার এ চুক্তির মধ্যে ভারত রাখতে চাইছে’, বলছিলেন ভৌমিক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ আছে চুক্তির মেয়াদ হবে ২৫ বছর, আর এর আওতায় বাংলাদেশকে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ারও প্রস্তাব আছে ভারতের। খবরে আরো বলা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী ওই চুক্তি করতে ভারত বিশেষভাবে আগ্রহী। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভারত কেন ভারত এরকম চুক্তি করতে চায়?
সুবীর ভৌমিক বলেন, ‘ভারতের একটা মূল্যায়ন হচ্ছে অন্য সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সেভাবে এগোয়নি।
এখানে ভারতের যে সমস্যাগুলো তার একটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার সমস্যা, আর দ্বিতীয় হচ্ছে চীন।’
‘এটা মাথায় রেখেই এ ধরনের একটা ডিফেন্স কো-অপারেশন প্যাক্ট ভারত করতে চাইছে, বিশেষ করে নর্থ-ইস্টার্ন রিজিয়নে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য।’ সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের দায়িত্বশীল কেউই বিস্তারিত কিছু বলছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র বিবিসিকে জানায়, ‘সফরে কী নিয়ে চুক্তি হবে বা হবে না, সেটি এত আগে বলা সম্ভব নয়, কারণ তা পুরোপুরি নির্ভর করছে দুই সরকার-প্রধানের মধ্যে আলোচনার গতিপ্রকৃতির ওপর।’
ওই সূত্রটি আরও যোগ করেছেন, ‘তবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সমস্ত দিক নিয়ে আলোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক, আর তাতে অর্থনীতি-অবকাঠামো উন্নয়ন, কানেক্টিভিটির পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টিও থাকতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে কি না, সেটা বলার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি।’
আর প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়টি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হকও কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেন, ‘এটা যখন ভিজিট হবে, তখনই আপনারা জানবেন যে কী কী চুক্তি হলো।
এ চুক্তিগুলো যেহেতু আলোচনার মধ্যে আছে – এমওইউগুলো – সেজন্য এখন এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করাটা যথাযথ হবে না বলেই আমি মনে করি।’ প্রতিরক্ষার বিষয়টি আলোচনার মধ্যে আছে কি-না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব কিছুই আলোচনার মধ্যে আছে। প্রতিরক্ষা সবসময়ই আলোচনার মধ্যে ছিল।’
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে কতগুলো বিষয়ে চুক্তি হতে পারে জানতে চাইলে শহীদুল হক বলেন, ‘দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে, আর সেগুলো সবগুলোই অলমোস্ট এমওইউ (সমঝোতা স্মারক)। দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের পরিধি এত বেশি যে মোটামুটি সব জিনিস নিয়েই আলোচনা হবে। বেশ কিছু সংখ্যক এমওইউ হবে। চুক্তি না।’
ভূরাজনৈতিক অবস্থান থেকে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ নির্ধারণ করে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। রাশিয়া-চীন-যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা সমরাস্ত্র এবং উন্নত সামরিক সরঞ্জাম নিয়মিত যুক্ত হচ্ছে সামরিক বাহিনীতে। সম্প্রতি চীন থেকে কেনা দুটি সাবমেরিনও যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে।
সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা থাকায় সার্বিক বিচারে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যে কোনো চুক্তি বা সমঝোতা বাংলাদেশের জন্য খুবই স্পর্শকাতর বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জামিল ডি. আহসান।
তার কথায়, ‘প্রতিটা দেশেরই সামরিক নীতি থাকে, এবং এগুলো নিজস্ব বিষয় এবং গোপনীয় বিষয়। তাই প্রতিরক্ষা বিষয়টি বা প্রতিরক্ষা চুক্তি যেমন স্পর্শকাতর, তেমনি ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কটাও কিন্তু স্পর্শকাতর।’ এদিকে বাংলাদেশের প্রধান রাজনীতিক দলগুলোকে ইদানিং ভারতের সাথে সম্পর্ক ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতেও দেখা যাচ্ছে। জেনারেল আহসান মনে করেন এ নিয়ে রাজনীতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। ‘রাজনীতি তো আমাদের জানেনই যে, তারা চেয়ে থাকে কোন ইস্যুতে রাজনীতি করা যায়। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা যায় বা গরম করা যায় রাজনীতির আসর ’ মন্তব্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা জামিল আহসানের।
এব্যাপারে উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজু বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে হাসিনা সরকার ভারতের সাথে সামরিক চুক্তি করতে চলেছে তা কখনই সফল হবে না। ১৯৭৫ এ সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যার সময়ও ভারতের সাথে ২৫বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি বলবৎ ছিলো কিন্তু ভারত মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠায়নি। এবারও চুক্তি করে হাসিনাকে শেষ রক্ষা করতে পারবে না ভারত।
জাহিদ এফ সরদার সাদী
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক বৈদেশিক উপদেষ্টা এবং বিএনপির বিশেষ দূত ।।