দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ রিপোর্টঃ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়া নিয়ে অসন্তোষ আর হতাশা ছিল বিএনপির তৃণমূলে। সেই হতাশা কাটাতেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়া। সন্দেহ ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে। বিশেষ করে নিশ্চিত জয় ছিনতাই হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ্যে তুলেছিলেন শীর্ষ নেতারা।
প্রথম ধাপে ভোটের ফলাফলে ব্যবধান কম থাকলেও দ্বিতীয় ধাপে সম্মানজনক জয় পেয়ে আশার সঞ্চার হয়েছিল তৃণমূলে। প্রার্থীদের মধ্যে বেড়েছিল উৎসাহ উদ্দীপনা। যদিও ধাপে ধাপে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছে প্রার্থীরা। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের সে শঙ্কার আগুনে অবশেষে ঘি ঢেলেছে চতুর্থ ধাপের ফলাফল।
তৃতীয় দফায় ৮০টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের দখলে আসে ৩৭টি আর বিএনপির ভাগ্যে জোটে ৩০টি। জামায়াতের দখলে যাওয়া ৭টি হিসাবে না ধরলে এ ফলাফল বিএনপির ভরাডুবি হিসেবেই চিহ্নিত হয়।
রোববার চতুর্থ ধাপের ৯১টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হয়েছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে আগে থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হলেও সহিংসতা আগের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিভিন্ন উপজেলায় ভোটগ্রহণ চলাকালে সহিংসতায় সরকার দলীয় ২ জন ও ১৯ দলীয় জোটের ২ জন নিহত হয়েছে।
গভীর রাতে গণনা শেষে বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায় সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের জয়-জয়কার। আগের তিন ধাপে যে ব্যবধানে এগিয়েছিল বিএনপি, তার চেয়ে বেশি ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে। আর সামনে এগিয়ে যায় আওয়ামী লীগ।
রাত আড়াইটা পর্যন্ত পাওয়া বেসরকারি ফলাফলে ৯১টির মধ্যে ৫৩ উপজেলায় জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আর এর অর্ধেক ২৫ উপজেলায় বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। এককভাবে বিএনপি পিছিয়ে রয়েছে ২৮টিতে। ১৯ দলের অন্যতম শরিক জামায়াতকে হিসাবে ধরলে এ জোটের চেয়ে আওয়ামী লীগ এবার এগিয়ে রয়েছে ২৩টিতে।
উল্লেখ্য, প্রথম ধাপে ৯৭ উপজেলায় আওয়ামী লীগ জয় পায় ৩৫টিতে। বিএনপি এককভাবে পায় ৩৮টি। জামায়াতের ১২টি ধরে ১৯ দলীয় জোটের বিজয় ৫০টিতে। এখানে এককভাবে আওয়ামী লীগ কম পেয়েছে ৩টিতে আর জোটগতভাবে ১৫টিতে।
দ্বিতীয় ধাপে ১১২ উপজেলায় বিএনপি বিজয়ী ৫১টিতে। জামায়াতের ৮টি ধরে তা দাঁড়ায় ৫৯টিতে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ পায় ৪৩ টি। এক্ষেত্রে এককভাবে আওয়ামী লীগ কম পেয়েছে ৮টিতে। জোটগত ব্যবধান সেখানে ১৬।
এরপর তৃতীয় ধাপে ৮০ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পায় ৩৭টিতে। আর বিএনপির ৭টি কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩০টিতে। এ ধাপে জামায়াত জয় পায় ৭টি উপজেলায়। এখানে এককভাবে আওয়ামী লীগ বেশি পায় ৭টিতে। আর জোটগত ব্যবধান আওয়ামী লীগের শূন্য হয়ে যায়।
হিসাবমতে, গত তিন ধাপে ২৮৯ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা বিজয়ী হয়েছে ১১৫টিতে আর বিএনপি ১১৯টিতে। একক ব্যবধানে আওয়ামী লীগ কম পেয়েছে ৪টিতে। জোটগতভাবে কম ২৭।
চতুর্থ দফার ফলাফল শেষে দেখা যায় ৩৮০ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৬৮, বিএনপির ১৪৪ আর জামায়াতের ৩১ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এককভাবে বিএনপি ২৮টিতে আওয়ামী লীগের থেকে পিছিয়ে। যদিও ১৯ দলীয় জোটের চেয়ে আওয়ামী লীগ ৯টিতে পিছিয়ে রয়েছে।
নির্বাচনের এ ফলাফল পাওয়ার আগে থেকেই স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোট। ভোটগ্রহণের আগে নির্বাচন কমিশন থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করা হয়। দুর্বৃত্তদের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেয়ার হুঙ্কারও দেয়া হয়। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা কেন্দ্র ও ব্যালট ছিনতাইকারীকে দেখামাত্র গুলি করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও মাঠে কোনো কাজ হয়নি।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুদ্দিন প্রধান (৪৫) খুন হয়েছেন। ৪৩টি জেলার অর্ধেকেরও বেশি জেলায় নির্বাচনী সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।
খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের নিজের উপজেলা চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, বোমা হামলা, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, অগ্নিসংযোগ ও পোলিং এজেন্টদের মারধরসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখল ও নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে সাতটি জেলার আটটি উপজেলার বিএনপি সমর্থিত, জাতীয় পার্টি (জাপা) সমর্থিত ও স্বতন্ত্র ২৫ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। ভোট গ্রহণের সময় কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনায় ৩২টি কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসাররা ভোট গ্রহণ স্থগিত করেছেন। সাতটি উপজেলা হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। গত তিন ধাপের নির্বাচনে সহিংসতার পরিসংখ্যানটাও ভীতিকর।
প্রথম ধাপে ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে দেশের নয়টি উপজেলায় বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেছে। ঘটনার প্রতিবাদে এসব উপজেলায় হরতাল ডাকে বিএনপি। হয়েছে। এদিন ৪০টি জেলার ৯৭টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হয়।
দ্বিতীয় ধাপে ২৭ ফেব্রুয়ারি ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জাল ভোট এবং ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ১১৫টি উপজেলা নির্বাচনে ১৫৩ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা।
তৃতীয় ধাপে ১৫ মার্চ কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই, ভাঙচুর, পুলিশের গুলির ঘটনায় ৮১টি উপজেলার মোট ২৬ কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়।