মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। সোমবার রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়। এর পর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার নির্দেশ দেন। এটি হবে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের ১০ নম্বর রায়। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ মোট ৯টি মামলার রায়ে ১০ জনের সাজা ঘোষণা করেন। সব রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল হয়েছে এবং আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। বাকি ৯ জনের সাজা আদালতে ঝুলছে। দুজন পলাতক ও বাকিদের আপিল আবেদনের বিচার কাজ চলছে।
নিজামীর বিরুদ্ধে করা মামলায় রোববার তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম আইনি পয়েন্টে যুক্তি উপস্থাপন করেন। তার যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করেন। ওই দিন তার যুক্তি উপস্থাপন অসমাপ্ত থাকায় সোমবার তা শেষ করেন।
গত বছর ২০ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল এক আদেশে নিজামীর মামলার রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে বলে অপেক্ষমাণ রাখেন। চাকরির মেয়াদ শেষে তিনি ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেলে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ না হওয়ায় বিচার কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়। পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের পর মামলাটির যুক্তিতর্ক ফের শুরুর নির্দেশ দেন।
বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর নিজামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গেল বছর ২৮ মে অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২৬ জন সাক্ষী এবং নিজামীর পক্ষে চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য ও জেরা শেষে ৩ থেকে ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। নিজামির পক্ষে ৭ নভেম্বর থেকে চার দিন যুক্তিতর্কের জন্য দিন ধার্য থাকলেও বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধের কারণে তার আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালে আসেননি। ফলে নিজামীর পক্ষে যুক্তিতর্ক ছাড়াই মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১০ সালের ২৯ জুন অন্য একটি মামলায় নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছর ২ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাবন্দি রয়েছেন।
নিষ্পত্তির পথে সাঈদীর আপিল : আপিল নিষ্পত্তির পথে এগিয়ে আছে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলা। এ আপিলের শুনানি শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গেল বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- ঘোষণা করেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। খালাস চেয়ে রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ মাওলানা সাঈদী আপিল করেন। অপরদিকে সবগুলো অভিযোগে সাঈদীর মৃত্যুদ- চেয়ে সরকারপক্ষ পৃথকভাবে আপিল করে। ৩ এপ্রিল আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিলের আবেদনের সারসংক্ষেপ জমা দেয় সরকার পক্ষ। সাঈদীর পক্ষে ১৬ এপ্রিল সারসংক্ষেপ জমা দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে এখন শুনানি চলছে। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
কামারুজ্জামানের আপিল : দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পরেই রয়েছে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের আপিল। খালাস চেয়ে তিনি আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষও সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি চলছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ৯ মে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিই সন্দেহাতীত প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেনি।
খালাস চেয়েছেন গোলাম আযম : ৯০ বছর কারাদন্ডের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আপিল করেছেন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম। তার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষও আপিল করেছে। এরই মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। গোলাম আযমকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সারসংক্ষেপ জমা দেয়ার সময় বেঁধে দেন আপিল বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত ১৫ জুলাই গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদ- ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে বলা হয়, অপরাধ মৃত্যুদন্ডের যোগ্য হলেও বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ৯০ বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে।
মুজাহিদের আপিল : ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ- ঘোষণা করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২। মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগের পাঁচটি সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়েছে। রায়ে প্রমাণিত পাঁচ অভিযোগে মৃত্যুদ- এবং প্রমাণিত না হওয়া দুই অভিযোগ থেকে মুজাহিদকে অব্যাহতি দেয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে ১১ আগস্ট আপিল করেন তিনি।
সাকা চৌধুরীর আপিল : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) খালাস চেয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেন ২৯ আগস্ট। এ বিষয়ে এখনও শুনানি শুরু হয়নি। সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ- ঘোষণা করে ১ অক্টোবর রায় দেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে প্রমাণিত ৯টিতে মৃত্যুদ- ছাড়াও সত্তর বছর কারাদ- ঘোষণা করা হয়। বাকি ১৪টি প্রমাণিত হয়নি।
আলীমের আমৃত্যু কারাবাস : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের আমৃত্যু কারাবাস ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ৯ অক্টোবর বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন। আলীমের বিরুদ্ধে আনা ১৭টি অভিযোগের মধ্যে পশ্চিম আমাত্রা গ্রামে গণহত্যা, ২৬ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ফজলুল করিমসহ ৩ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আবুল কাশেম হত্যাকান্ডসহ ৯টি অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমাণিত হয়েছে। এসব অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদ-যোগ্য হলেও আবদুল আলীমের বয়স, বার্ধক্য ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়নি। সার্বিক বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল চারটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাবাস, অপর পাঁচটিতে ৯০ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন তিনি; তবে শুনানি শুরু হয়নি।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় ঘোষণা হয় ২১ জানুয়ারি। ওই রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মামলার শুরু থেকেই বাচ্চু রাজাকার পলাতক। একই ভাবে পলাতক রয়েছেন সাজাপ্রাপ্ত আসামি আলবদর নেতা চৌধুরী মুইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। ৩ নভেম্বর এক রায়ে তাদের মৃত্যুদ- ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনই প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে লন্ডনে বসবাস করছেন। এদিকে জামায়াত নেতা আবদুস সোবহান, একেএম ইউসুফ, এটিএম আজহার, মীর কাশেম আলী, সৈয়দ মোঃ কায়সার, মোবারক হোসেন ও জাহিদ হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে মামলা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে।