সন্ত্রাসী ও অপরাধী সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা মঙ্গলবার সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রিপোর্টটি উপস্থাপন করবে। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। তদন্ত প্রতিবেদনটি পর্যালোনা করবেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা। এরপর সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নজরে আনবে রাষ্ট্রপক্ষ। এপ্রিল মাসেই এর বিচার শুরু করা যাবে।
৪৪তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া দেশের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এটি হবে বাংলাদেশে সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর প্রথম পদক্ষেপ। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, দল হিসেবে যৌথ দায়দায়িত্বের (কমন রেসপনসিবিলিটি) অভিযোগে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
মঙ্গলবার এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রথমে সাংবাদিকদের কাছে এবং পরে ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কাছে উপস্থাপন করা হবে এ সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত বর্তমানকে বলেন, তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করা হবে। মামলা করার প্রয়োজনীয় উপাদান থাকলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৯(১) ধারা অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের সামনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করব। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত জামায়াত নেতাদের ব্যক্তি হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার বিচার করা হয়েছে। এবার বিচারের আওতায় আনা হবে সংগঠন হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গত রবিবার এক বৈঠকে মিলত হয়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। তদন্ত সংস্থার প্রধান আবদুল হান্নান খানের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে অপরাধী ও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের তদন্ত প্রতিবেদনটি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের কাছে জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
আবদুল হান্নান খান বলেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার বিষয়ে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ধানমণ্ডির সেইফ হোমের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন হবে। এরপর তদন্ত প্রতিবেদন ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে দাখিল করা হবে। তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। ট্রাইব্যুনাল যদি অভিযোগ গ্রহণ ও গঠন করেন তাহলেই জামায়াতের বিপক্ষে বিচার শুরু হবে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বাংলা একাডেমি থেকে প্রদত্ত তথ্যাবলি, পত্রিকার কাটিংসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এ তদন্ত করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গত বছরের ১৮ আগস্ট থেকে প্রায় আট মাস বিভিন্ন নথিপত্র, স্থান পরিদর্শন করে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালে পরিচালিত বিভিন্ন মামলায় দাখিল করা নথিপত্রকেও জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রমাণপত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের দেয়া অধিকাংশ রায়ে জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন (ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন) বলে অভিহিত করা হয়েছে।
একই সঙ্গে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির কোনো ব্যক্তিকে যেন রাষ্ট্রীয় কোনো পদে অধিষ্ঠিত করা না হয় সে ব্যাপারেও পর্যবেক্ষণ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবু্যনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩ আইনে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের জন্য কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে বিচার করার কোনো বিধান ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে এ আইনটি সংশোধন করার সময়ও এমন কোনো বিধান রাখেনি। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের দাবির মুখে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে আইনটি পুনরায় সংশোধন করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ ও ব্যক্তির পাশাপাশি অপরাধী হিসেবে সংগঠনেরও বিচার করার বিধান সংযুক্ত করা হয়।
যার ফলে জামায়াতের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা সম্ভব হচ্ছে। সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনা হয়। জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা চলাকালে একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাসে যারা জামায়াতের অপরাধ ও নির্যাতনমূলক কার্যকলাপ স্বচক্ষে দেখেছেন, দেশে বা বিদেশে অবস্থানরত সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। গত বছরের ১৫ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গোলাম আযমকে ৯০ বছরের সাজা দেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে, জামায়াত অপরাধী ও সন্ত্রাসী সংগঠন। একাত্তরে তাদের ভূমিকা ছিল দেশের স্বার্থের পরিপন্থী। রায়ের অভিমতে বলা হয়, দলটি গত ৪২ বছরেও তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি বা অনুশোচনা করেনি।