ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আজ ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী , বরেন্য অর্থনীতিবীদ এবং রাজনীতিক জনাব এম সাইফুর রহমানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী।
এম সাইফুর রহমান। ইতিহাসের ক্ষণজন্মা এক মহাপুরুষের নাম। এই নামটির সাথে যেনো মিশে আছে বাংলাদেশ তথা সিলেট বিভাগের উন্নয়ন।
মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি ইন্তেকাল করেছেন আজ ৯ বছর। কিন্তু দেখতে দেখতে নয়টি বছর পেরিয়ে গেলেও এই বিশ্ব বরেণ্য রাজনীতিককে আজো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বৃহত্তর সিলেটবাসীসহ গোটা বাংলাদেশের মানুষ।
প্রয়াত এই বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ এবং সফল অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ২০০৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক সড়ক দুর্ঘটনায় সিলেটসহ দেশবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। সেদিন তিনি
সিলেট সফর শেষে বাড়ি হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে ওইদিন বিকেল পৌনে ৩টায় ঢাকা-সিলেট মহসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের খাড়িয়াল এলাকায় দুর্ঘটনায় পতিত হয় সাইফুর রহমানকে বহনকারী গাড়ি।
রাস্তা থেকে গাড়িটি ছিটকে পাশের খাদে পানিতে ডুবে নিমজ্জিত হয়। এ সময় দ্রুত উদ্ধার করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এম. সাইফুর রহমানের আকস্মিক মৃত্যুতে সেদিন বৃহত্তর সিলেটসহ সারাদেশে তার অগণিত ভক্ত অনুরাগীর মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া।।
দেশের স্বনামধন্য সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী, বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিবিদ এম সাইফুর রহমানের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। এদিনে আমরা উনার আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
দলমতের উর্ধ্বে থেকে জাতীয় ও দেশের স্বার্থে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এম সাইফুর রহমান ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। মাতৃভূমির স্বাধীনতা, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভাষা আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সব সময় থেকেছেন সামনের কাতারে।
সাইফুর রহমানের জন্ম ১৯৩২ সালের ৬ই অক্টোবর, মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বাহারমর্দনে। উনার পিতা মোহাম্মদ আবদুল বাছির, মাতা তালেবুন নেছা। ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। মাত্র ৬ বছর বয়সে তার পিতা মারা যান। সে সময় তার অভিভাবকক্ত গ্রহণ করেন চাচা মোহাম্মদ সফি। শিক্ষাজীবন, গ্রামের মক্তব ও পাঠশালা শেষ করে তিনি ১৯৪০ সালে জগৎসী গোপালকৃষ্ণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হন। সিলেটের এমসি কলেজ থেকে আইকম পাস করে ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে চলে যান। সেখানে পৌঁছার পর মত পাল্টে যায় তার। ব্যারিস্টারির পরিবর্তে পড়েন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি। ১৯৫৩-৫৮ সময়কালে পড়াশোনার পর ১৯৫৯ সালে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ফেলোশিপ অর্জন করেন। এছাড়া তিনি আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯৬০ সালের ১৫ই জুলাই বেগম দূররে সামাদ রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তিনি ৩ পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের জনক। এম সাইফুর রহমান ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে লেটার মার্ক পেয়ে মেট্টিক, ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন সাইফুর রহমান এবং কারাবরণ করেন।
তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে। এবং তিনি ১৯৭৮ সালের বিএনপি প্রতিষ্ঠাকালীন আহবায়ক কমিটির সদস্য যেই কমিটির আহবায়ক ছিলেন বীর-উত্তম জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালে মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করলে এম সাইফুর রহমান ওই বছরের ২০ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি আবার মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) এবং সিলেট-১ (সদর-কোম্পানীগঞ্জ-১) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে সংসদে ১২ বার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড করেন সাইফুর রহমান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি তিন ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন। ২০০৩ সালে তার স্ত্রী দুররে সামাদ রহমান ইন্তেকাল করেন।
তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাহারমর্দনে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) প্রতিষ্ঠালগ্নে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তাকে আপন করে ডাকলেন দল গঠনে অংশ নিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হতে। তিনি তাই করলেন।
রাজনীতিতে এলেন, আলোকিত করলেন, আলোকিত হলেন। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসন ও ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের ৮ই জুন তিনি সংসদে দ্বাদশ বাজেট পেশ করে দেশের সংসদীয় ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক বাজেট পেশকারী হিসেবে রেকর্ড গড়েন।
তিনি দীর্ঘদিন দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন ছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনসহ দেশ-বিদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন।
১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় তিনি দেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) চালু করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৯৪-৯৫ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান, ১৯৮০-৮২ ও ১৯৯১-৯৫ সময়কালে তিনি বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ও ইফাড এর বাংলাদেশ গর্ভনরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি একনেকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
তার জীবদ্দশায় দেশ ও বৃহত্তর সিলেট নিয়ে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা করেছিলেন তার অনেকগুলো বাস্তবায়ন হলেও পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। হঠাৎ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ, স্তব্ধ হয়ে যায় তার দেখা উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার স্বপ্ন।