ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়ছে লাগামহীনভাবে কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না রপ্তানি আয়। ফলে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে আকাশচুম্বী। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জানুয়ারি) ৭ মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। যা গত ৪৭ বছরে সর্বোচ্চ অর্থাৎ স্বাধীনতার পর দেশে এত পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খাদ্যপণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়লেও সেই হারে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ছে না। তাই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। তবে আমদানির এ প্রভাব উৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগে পড়লে তা হবে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু আমদানির আড়ালে এই অর্থ যদি পাচার হয়ে যায় তাহলে তা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
এই ঘাটতি সমন্বয় করতে রপ্তানি, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ ও বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থপাচার হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে ইপিজেডসহ রপ্তানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ২ হাজার ১০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ১ হাজার ১২ কোটি ৩০ ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, প্রতি ডলার ৮২ টাকা হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর শতাংশের হারে আলোচিত সময়ে আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ। কিন্তু রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।
এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে; ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩২ কোটি ডলার।
চলমান কয়েকটি বড় প্রকল্পের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের জন্য যন্ত্রাংশ আমদানিতে অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তাই আমদানি ব্যয় বাড়ছে। তবে তুলনামূলক সেই হারে রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাড়েনি। তাই বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে।
তবে এই আমদানির আড়ালে অর্থপাচার হচ্ছে কিনা তা অনুসন্ধান করা দরকার বলে জানান এই অর্থনীতিবিদ।
খাদ্যপণ্য আমদানির কারণে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, এবার সবচেয়ে বেশি আমদানি বেড়েছে খাদ্য জাতীয় পণ্যের। তাছাড়া বড় প্রকল্পগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতিও আমদানি করা হয়েছে। তাই আমদানি ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সেই হারে রপ্তানি বাড়েনি।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে রপ্তানি বাড়ানোর বিকল্প নাই জানিয়ে তিনি বলেন, রপ্তানি বাড়াতে বিশ্ববাজারের সাথে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত হতে হবে। শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি জরুরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
আবু আহমেদ বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে ঋণ বিতরণ বাড়াতে হবে বেসরকারি খাতে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগ। বিনিয়োগ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঋণের সুদ হার কমাতে। কিন্তু এভাবে বললে লাভ হবে না। সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরজুড়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। বৈদেশিক দায় পরিশোধে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১৪৮ কোটি ডলার ঋণাত্মক হয়। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে ৫৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এর পরিমাণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল ৮৯ কোটি ডলার।
আলোচিত সময়ে সেবাখাতে বিদেশিদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়েছে ৫০৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর এ খাতে আয় করেছে মাত্র ২৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ফলে সেবা খাতে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৯৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বিদেশি বিনিয়োগও কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে মোট ১১০ কোটি ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৩ কোটি ডলার।