দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ বিশ্লেষনঃ একের পর এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে বিএনপি। নানা চেষ্টা সত্ত্বেও আন্দোলন, নির্বাচন, দল পুনর্গঠন- কোনোটিই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারছে না দলটি। পাঁচ দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে এগিয়ে থেকেও দলটি শেষ পর্যন্ত ফল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে হাজার হাজার মামলায় জর্জরিত এ দলের শীর্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের নেতারা। সিনিয়র অনেক নেতা কারাবন্দি।আওয়ামী লীগের কূটকৌশলের কাছে বার বার যেনো মার খেয়ে যাচ্ছে সৎ আন্দোলন।
উপরন্তু দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি এবং দলের চেযারপারসন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মন্তব্য নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে দলটি। চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে ফল বিপর্যয়কে সাফল্যের পূর্বাভাস ও সাংগঠনিক রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বললেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বাপর নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা কাটিয়ে উঠতে ও বিপর্যয়ের ধকল সামলাতে ঘর গোছানোর কৌশল নিয়েছিল বিএনপি।
এজন্য সারা দেশে দলের তৃণমূল নেতাদের মতামত নেয়া হয়। তাদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয় আন্দোলনের সুফল ঘরে না ওঠার কারণ। অনেককে নিজ এলাকায় গিয়ে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়। বৈঠক হয় ঢাকা মহানগর বিএনপি পুনর্গঠন নিয়ে। উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে অবার স্থবির হয়ে পড়ে এসব কার্যক্রম। জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দিতীয় ধাপে আসন বেশি পেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু দলের বিদ্রোহী, জোটের শরিক জামায়াতের প্রার্থী এবং কারচুপি ও কেন্দ্র দখলের তোড়ে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে অনেকটা পিছিয়ে গেছে তারা। হাতছাড়া হয়েছে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বগুড়া, ফেনী, মুন্সীগঞ্জ ও নোয়াখালীর অনেক আসন।
প্রথম দফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি ১১টি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে বেশি নির্বাচিত হয়। দ্বিতীয় ধাপেও ভালো করে বিএনপি-জামায়াত। শুরুতে ১১৫টি উপজেলার ফলেও বিএনপি বেশি উপজেলায় জয়ী হয়। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হন ৫২টিতে আর ৪৬টিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তৃতীয় ধাপ থেকে পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। এ পর্বে ৮১টি উপজেলার মধ্যে বিএনপি পায় ২৬টি, আওয়ামী লীগ ৩৭টি এবং জামায়াত ৭টি। দখল, বর্জন, জালিয়াতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে পঞ্চম ধাপের পর ঘোষিত ফলে দেখা যায়, ৪৫৪টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২, বিএনপি ১৫৩, জামায়াত ৩৬, জাতীয় পার্টি ৩, বিদ্রোহীসহ অন্যান্য ৪০ প্রার্থী জয় পেয়েছেন। পাঁচ দফা নির্বাচনে ৪৫৯ উপজেলার মধ্যে ফল ঘোষিত হয় ৪৫৪ উপজেলায়। পাঁচ উপজেলার ফল স্থগিত রয়েছে। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বিএনপি। ঘোষণা দেয়া হয়, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না গিয়ে তারা জোরদার করবে সরকার পতনের আন্দোলন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হয়েছে, এ সরকার একটি দানব সরকার। এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে বিএনপি জাতীয় নির্বাচন না করার যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এ নির্বাচনের মাধ্যমে তা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, এ অবৈধ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য ১৯ দলীয় জোটের আন্দোলন আরও বেগবান করা হবে। আর এ উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল তারই একটি প্রক্রিয়া।
স্থানীয় নির্বাচনকে ইস্যু করে আন্দোলনে নামার বিষয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে বলে মনে করেন দলটির অনেক নেতা। তাদের মতে, নির্বাচনে অনিয়ম, দখল, নির্যাতন ও হামলার অভিযোগে নতুন অনেক ইস্যু রয়েছে ঠিকই। এসব বিষয়ে জনমতও ব্যাপক। তবে দলের সাংগঠনিক অবস্থা আন্দোলনের পক্ষে সহায়ক হবে কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে। তা না হলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিরোধের অন্দোলনের মতোই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে নতুন কর্মসূচি। দল পুনর্গঠন না করে আবার আন্দোলনে যাওয়াটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে।
এক-এগারোর সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা ব্যাপক হারে গ্রেফতার ও নির্যাতনের মুখোমুখি হন। দলটির নেতাদের দাবি, সেই থেকে শুরু করে এখনও বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে গত সরকারের শেষ বছরটিতে, অর্থাৎ ২০১৩ সালে বিএনপির ওপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন হয়েছে বলে মনে করেন তারা। ওই বছরটিতে বিএনপি ভাঙার নানা ষড়যন্ত্রও হয়েছিল। দলের সিনিয়র প্রায় সব নেতাকেই জেলে যেতে হয়েছিল।
সে সময় ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিরোধে ২৯ ডিসেম্বর ‘রোড ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। ওই কর্মসূচির প্রস্তুতির আগেই কঠোর ব্যবস্থা নেয় সরকার। ২৯ নভেম্বর দ্বিতীয় দফায় টানা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ঘোষণা দেয়ার পর ৩০ নভেম্বর ভোরে কমান্ডো স্টাইলে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় রিজভী আহমেদকে। গ্রেফতারের পরই পুরোপরি নেতাকর্মীশূন্য হয়ে পড়ে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সেখানে অবস্থান নেয় পুলিশ এবং তাদের জলকামান ও রায়ট কার। রিজভীকে গ্রেফতারের পর দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে দফতরের দায়িত্ব দিলেও গ্রেফতার-হয়রানি এড়াতে কার্যালয়মুখী হননি তিনি; বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন আত্মগোপনে থেকে। আজ্ঞাতবাসে যান দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা। এ অবস্থার মধ্যেও সারা দেশে সড়ক, নৌ ও রেলপথ অবরোধের কর্মসূচি পালন করছে তৃণমূল নেতাকর্মীরা। শুধু ব্যতিক্রম ছিল ঢাকা মহানগর। কেন্দ্রীয় নেতাদের অজ্ঞাতবাসে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালনে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যখন মাঠে, তখন কেন্দ্রীয় নেতাদের এভাবে আত্মগোপনকে মেনে নিতে পারছিলেন না তারা। এতে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে দলীয় নেতাকর্মীসহ সমর্থকদের মধ্যে।
সরকারের উদ্দেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বার বার ঘোষিত তফসিল স্থগিত করার দাবি জানলেও কর্ণপাত করেননি ক্ষমতাসীনরা। চলতে থাকে লাগাতার অবরোধ। এতে সারা দেশের সঙ্গে ঢাকা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও সফলতা আসেনি আন্দোলনে। এর মধ্যে ব্যর্থ হয় জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সমঝোতার বৈঠক। ঘনিয়ে আসে নির্বাচনের দিনক্ষণ। স্তিমিত হতে থাকে নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনের সম্ভাবনা। ২৫ ডিসেম্বর গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। গ্রেফতার করা হতে থাকে দলের সিনিয়র নেতাদের। ২৯ ডিসেম্বরের ‘রোড ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচিকে সামনে রেখে নিজ বাসায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। এ পরিস্থিতিতে ঘোষণা দেয়া হয়-যেখানে বাধা সেখানেই আন্দোলন। ঢাকাকে কেন্দ্র করে সারা দেশের নেতাকর্মীরা জীবনবাজি রেখে কর্মসূচিতে এগিয়ে এলেও ঢাকার নেতাকর্মীদের অজ্ঞাতবাস ও অসহযোগিতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন খালেদা জিয়া। ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় পতাকা হাতে সবাইকে ঢাকায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমবেত হতে অনুরোধ জনালেও সরকারি বাধায় খালেদা জিয়ার এ আহ্বান কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় আরও কঠোর অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নজিরবিহীন বাধায় ভন্ডুল হয় ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’ কর্মসূচি। গুলশানের বাসা থেকে বেরোনোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। এদিন রাজধানীর অবশ্য অন্য কোনো স্থানে কোনো নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। অবরুদ্ধ আর ধর-পাকড়ের মধ্যেই আটকে থাকে প্রধান বিরোধী দলের কর্মসূচি। গুলশানের নিজ বাসায় অবরুদ্ধ হয়ে থাকেন খালেদা জিয়া। একের পর এক আটক হন দলের সিনিয়র নেতারা। বিএনপি জোটের বর্জন ও আন্দোলনের হুমকির মধ্যেই ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পর পরই তড়িঘড়ি সরকার গঠন করে। সরকার এখন বহাল তবিয়তেই রয়েছে। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়। দলে এ নিয়ে বিরোধ থাকলেও সংগঠনকে চাঙ্গা করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনদের কারচুপির কারণে সফলতা আনতে পারেনি তারা। ফলে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর পথে বারবার হোঁচট খাচ্ছে।