DMCA.com Protection Status
title="৭

মায়ের পছন্দ অপছন্দের কতটুকু খোঁজ রাখে সন্তানেরা।

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  পরম যত্নে মা তার জীবনের অনেকটা সময়, শ্রম দিয়ে সন্তান বড় করে তোলেন। সন্তান কী পছন্দ করে, কোনটা কখন তার দরকার সবই মায়ের নখদর্পণে থাকে। তবে সন্তান কি জানতে চায় মায়ের কী পছন্দ, প্রিয় রঙ কী, কিংবা মা কবে শেষ সিনেমা দেখেছে? বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল পদে কর্মরত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে হল জীবন শুরুর পরে, কেউ কেউ মাকে নিয়ে নির্মিত বিদেশি সিনেমা দেখার পর মায়ের কথা গুরুত্ব দিয়ে আলাদা করে ভাবার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। কেউ বলছেন, মায়ের কথা গুরুত্ব দিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে এই বোধটাই তৈরি হতে সময় নেয়। আবার কেউ বলেছেন, বোধ তৈরির আগেই মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

 

 

বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করেন জাহিদ হোসেন। মাকে নিয়ে ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মা একা ঘুমাতে পারে না। এসি গাড়িতে চড়তে পারে না। ওষুধে ডায়াবেটিস কন্ট্রোল হচ্ছে না, কিন্তু কিছুতেই ইনসুলিন নেবে না। মা এখন কোনও নির্দেশ দিতে পারে না।…তার আর কোনও জোরাজুরি নেই। মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। কেন মা আগের মতো অ্যাকটিভ থাকে না? কেন মা সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয় না? আর ঠিক তক্ষুনি ভাবি, মাত্র ৫৩ বছর আগে, আমার তরুণী মায়ের কোলের ছেলে আমিও তো ঠিক এমনই অসহায় ছিলাম। মা তো তখন বিরক্ত হননি! বড় হয়ে মা এখন একেবারে ছোট্ট হয়ে গেছে। মা এখন যেন আমারই বাচ্চা মেয়েটা! মায়ায় ভরে ওঠে মন। বেঁচে থাকো মা। কেবল বেঁচে থাকো। পাশে থাকো। আর কিছু দরকার নেই আমার।’

ঠিক কবে থেকে মাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবনা কাজ করে, মায়ের ভালোমন্দ জানতে ইচ্ছে করে-এ প্রশ্নের জবাবে জাহিদ বলেন, ‘যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়লাম, সেইদিন থেকেই আলাদা টান।’

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংবাদিক বলেন, ‘মায়ের পছন্দের বিষয়টি প্রথম আমার মাথায় আসে কলকাতার একটি সিনেমা দেখার পর। এরপর মায়ের সঙ্গে কথা বলি এ নিয়ে। জানার চেষ্টা করি মায়ের পছন্দ কী।’

মায়ের পছন্দের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘ববিতাকে দেখে আমরা বড় হই। এরপর শাবনূরের সিনেমা বেশি ভালো লাগে। বইয়ের ক্ষেত্রে নীহাররঞ্জন, রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়েছি। এখন বেহেশতি জেওর পড়ি, কোরআনের তরজমা পড়ি।’

তিনি জানান, ‘এখন আমি জানি আমার মা কী খেতে পছন্দ করেন, কী রঙ পছন্দ করেন। আমার এটা ভালো লাগে, ছোটবেলায় মা আমার পছন্দের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতেন। এখন আমি মায়ের পছন্দের বিষয়গুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।’

উদ্যোক্তা কাকলী তানভীর মা হওয়ার আগে কখনও তার মায়ের দিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে বলেন, ‘মায়ের নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে তার সঙ্গে তর্ক করতাম। মা কেন বলছেন বোঝার চেষ্টা করতাম না। আমি নিজে যখন মা হলাম তখন বুঝলাম মা কী কঠিন পরিশ্রম করে সন্তানকে মানুষ করেন। তিনি যা কিছু ভাবেন সন্তানের ভালোর জন্যই ভাবেন। তখন থেকে তার নানা ভালো লাগা মন্দ লাগা নিয়েও আলাদা করে সময় করে নিয়ে কথা বলা। তার সঙ্গে সময় কাটানোর মতো বিষয়গুলো আমাদের দু’জনের জীবনে শুরু হয়।’

 

বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত সালাউদ্দিন ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন। ঢাকায় চাকরি শুরুর পরেও মা নিয়ম করে খোঁজ নিতেন কোথায় থাকছে, খেয়েছে কিনা, মাস শেষে টাকা আছে কিনা। কিন্তু মা চাকরিজীবী হলেও যে তার ভালোমন্দ খোঁজ নিতে হয় তা মনেই হয়নি কখনও। সেই বোধ তৈরি হওয়ার আগেই মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

তিনি বলেন, ‘ছোট থেকেই দেখেছি মা একহাতে সংসার সামলে চলেছেন, চাকরি করছেন, টাকা-পয়সার টানাটানি নেই। তিনিই সবাইকে দেখে রাখছেন ঠিকই, কিন্তু তারপরেও তার খোঁজ নেওয়া, তার ভালোমন্দ জানাটাও যে জরুরি সেই চিন্তাই আসেনি কখনও। এখন মিস করি সবকিছু। মনে হয়, মা নিশ্চয় মনে মনে চাইতেন, তার খোঁজ কেউ রাখুক।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সন্তান যখন শুরু থেকে অভিভাবকের কাছ থেকে শর্তহীন সবকিছু পেতেই থাকে তখন তার বেড়ে ওঠার মধ্যে এই বোধ তৈরি হয় না যে, যা কিছু নিচ্ছি এই জগৎ থেকে তার প্রতিদানের দরকার আছে। আমরা সন্তানদের সেভাবে গড়ে তুলি না। ফলে তারা যতক্ষণ না নিজেরা মা-বাবা হয়ে এসবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ বুঝতে পারে না আচরণটা কেমন হওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে কাউন্সেলিংয়ের জন্য অনেক কিশোর আসে যারা অভিযোগ করে তাদের বাবা-মা তাদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তারা একবারও ভাবছে না তাদের বাবা-মা সর্বোচ্চটাই দিচ্ছেন বলেই সে ভালো থাকুক সেটা চেয়েই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে এসেছেন। এই পরিস্থিতি নতুন কিছু না, প্যারেন্টিং নিয়ে ভাবতে হবে। পারস্পরিক টান কীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!