ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে কারাবন্দি রয়েছেন। চাহিদা অনুয়ায়ী চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোন কিছু খেতেও পারছেন না। কিন্তু এতো কিছুর পরও মনোবলের দিক দিয়ে বিন্দু মাত্র টলানো যাচ্ছে না রাজপথের আন্দোলনে আপোষহীন নেত্রীর খেতাব পাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে।
২০১৪ সালে যে কারণে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। নিজের শারীরিক অসুস্থতা, কারাবন্দি, দলে নেতাদের নানা নাটকীয় সিদ্ধান্তসহ এতো প্রতিকুলতার মধ্যেও সেই একই কথাতেই অবিচল রয়েছেন তিনি। নিজের নীতিবিরোধী কোনো প্রস্তাবেই রাজী করানো যাচ্ছে না তাকে।
গত ১৪ এপ্রিল দলের সিনিয়র তিন নেতাকে সরাসরি না করে দিয়েছেন নিজের প্যারোলে মুক্তি ও নির্বাচিত এমপিদের শপথের বিষয়ে। এবার উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে ক্ষোভ ঝেড়েছেন দলের নেতাদের প্রতি। দল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা নেতাদের নাটকীয় সব সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়লেও প্রেরণা খুঁজছেন বেগম জিয়ার অনড়-আপসহীন মনোবলেই।
নির্দলীয় সরকার ছাড়া শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ নেবেন না বলে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। একই দাবিতে ওই সরকারের বাকীটা সময় আন্দোলন চালিয়ে গেছেন তিনি। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হওয়ার আগ পর্যন্তও একই কথা বলে গেছেন।
দলটির নেতারাও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলেছেন নির্দলীয় সরকার ও বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোন নির্বাচন হতে দেবেন না এবং শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচনে তারা যাবেন না। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সেই সিদ্ধান্ত বদলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। নির্বাচনের আগের দিন রাতে ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করে দলটির সিনিয়র নেতারা। নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির এমপিরা শপথ নেবেন না বলেও ঘোষণা দেয়া হয়।
বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে যাবে না জানিয়ে বছরের শুরুর দিকে উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করে বিএনপি। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তাদের বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু নানা নাটকীয়তায় গতমাসে বিএনপি মহাসচিব ছাড়া বাকীরা সংসদে গিয়ে শপথ গ্রহণ করেন। বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল শপথ না নেয়ায় সেই আসন শূণ্য ঘোষণা করে উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগের অবস্থান থেকে সরে এসে সংসদে শপথ নেয়ায় বিস্মিত হন দলটির নেতাকর্মীরা।
তবে সর্বশেষ ২০ দলীয় জোটের এক সভায় বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংসদে সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেবে বিএনপি। একইসাথে বগুড়ার উপনির্বাচনেও অংশ নেবে দলটি। দলের এমন সিদ্ধান্তে সিনিয়র নেতাদের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। ক্ষোভ নিরসনে স্থায়ী কমিটির বৈঠকও ডাকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এই উপ-নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়াসহ ৫জনকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করার জন্য দলের একটি মনোনয়ন ফরম বুধবার সকালে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার কাছে পাঠানো হয়। তিনি এই ফরমে স্বাক্ষর না করেই ফিরিয়ে দেন এবং নির্বাচনে দলের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপির সংসদে যাওয়া এবং দলটির এমপিদের শপথ গ্রহণের বিষয়ে মত ছিল না বিএনপি চেয়ারপারসনের। কারণ এ সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তও তার কাছ থেকে আসে। দলের সিনিয়র নেতাদের অনেকে মনে করেন বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের পর যেখানে দল উপজেলা নির্বাচন ঘোষণা দিয়ে বর্জন করেছে। সেখানে দলের মহাসচিবের শূণ্য আসনে অংশগ্রহণ করা ঠিক নয়।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, কারাবিধি অনুযায়ী বিএনপি চেয়াপারসনের একান্ত সচিব আবদুস সাত্তার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র হস্তান্তর করেন। সেখান থেকে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) পাঠানো হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া মনোনয়নপত্র দেখেই ক্ষুব্ধ হন।
ক্ষুব্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন,এই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিলো? আমি তো কিছুই জানি না। আমাকে কেন বিষয়টি জানানো হয়নি? এদিকে খালেদা জিয়া সম্মত না হওয়ায় এ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দলের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, যেখানে চেয়ারপারসন নির্বাচন করতে আগ্রহী নন, সেখানে দল যাওয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে? বিএনপির সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই বগুড়া নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে বলে জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার বলেন, বেগম জিয়ার কাছে মনোনয়নপত্র পাঠানো হলেও তিনি তাতে স্বাক্ষর করেননি। তিনি নির্বাচনে করতে রাজি নন বলে জানিয়েছেন। শায়রুল কবির খান বলেন, বগুড়ার নেতাদের দাবির মুখে খালেদা জিয়ার নামে ফরম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ম্যাডাম ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে অসম্মতি জানায়। এ কারণে বাকী চারজনের মনোনয়ন ফরম জমা দেবেন।
এদিকে সপ্তাহখানেক ধরে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বগুড়া উপ-নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঠিক হবে কি-না জানতে চান। তবে সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দেন। যদিও দলের গুরুত্বপ‚র্ণ এক নেতার সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচনে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন তারেক রহমান। সে অনুযায়ী গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বগুড়া জেলা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে স্কাইপির মাধ্যমে বৈঠক করেন তারেক রহমান। সেখানে তিনি উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দেন। খালেদা জিয়াসহ দলের ৫ নেতা মনোনয়নপত্র জমা দেবেন বলেও সিদ্ধান্ত হয়।