দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ ভারতের সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে নিজ দলের বিপর্যয়ে চরম ধাক্কা খান কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। একই সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এরফলে মুষড়ে পড়েন। এ অবস্থায় রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন।
আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দলের দায়িত্বে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু দুজনের ক্ষেত্রেই তা হতে দেননি দলের নেতারা। রাহুলের পেছনেও এসে দাঁড়িয়েছে দল, মমতার পাশেও এসে দাঁড়িয়েছেন দলীয় নেতারা। নির্বাচনের ফল নিয়ে দিল্লিতে বৈঠকে বসেছিল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। আর কলকাতায় কালীঘাটের বাড়িতে নির্বাচনী ফল পর্যালোচনা বৈঠকে বসেছিলেন মমতা। নির্বাচনে পরাজয়ের দায় মাথায় নিয়ে শনিবার কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রাহুল গান্ধী সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। দলের সব নেতারা তা খারিজ করে দিয়েছেন। দল শেষ পর্যন্ত আস্থা রেখেছে রাহুল গান্ধীর উপরেই। তাকে আরও বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে দলকে শক্তিশালী করতে। এ অবস্থায় নেতাদের আবেগে আটকে গেলো রাহুল ও মমতার পদত্যাগ।
এদিকে, লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দলের সাফল্য-ব্যর্থতা পর্যালোচনায় শনিবার বৈঠকে বসেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই তিনি তার হতাশা ব্যক্ত করে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে সে কথা জানিয়ে তৃণমূল নেত্রী বলেছেন, পাঁচ মাস আমাকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। তিন মাস ধরে নির্বাচন চলছে। তার আগে দুমাস ধরে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছিল কমিশন। অপমানিত বোধ করছি। এই পরিবেশে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে থাকতে চাই না, দলের সভানেত্রী থাকতে চাই। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, চেয়ার আমার কাছে কিছু নয়। আগেও অনেকবার ছেড়ে এসেছি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার মানসিকতা নেই। বৈঠকে তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেবার কথা দলকে সারাদিন ধরে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তবে দল কিছুতেই তা মেনে নেয়নি বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন।
সেইসঙ্গে মমতা এদিন প্রকাশ্যেই বলেছেন, একটাই শর্তে মুখ্যমন্ত্রী থাকতে রাজি, যদি সবাই একজোট হয়ে কাজ করে। এদিন দলের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক রয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মমতা। তৃণমূল কংগ্রেসের কেউ কেউ বিজেপির কাছ থেকে টাকা খেয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন মমতার গলায় ছিল হতাশার সুর।
তিনি বলেছেন, যারা আমাদের ভোট দেননি তারা নিশ্চয়ই আমাদের অপছন্দ করেন। এটা আমার বিবেকে লেগেছে। হতাশার সঙ্গে তিনি বলেন, উন্নয়নের কোনো মূল্য নেই। মানুষের কাজ একটু বেশি করে ফেলেছিলাম মনে হচ্ছে। মমতার অভিযোগ, পাঁচ মাস ধরে কোনো কাজ করতে দেয়া হয়নি। রাজ্যে এমার্জেন্সির মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। সে সঙ্গে তিনি কিছুতেই সাম্প্রদায়িক ও টাকার এই নির্বাচনকে মেনে নিতে পারছেন না বলেও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র টাকার কাছে বিকিয়ে গেলে সেই গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে যায়। এ রকম আগে কখনও হয়নি। মমতা বলেছেন, উগ্র হিন্দুত্ববাদ মানি না। সহনশীলতা থাকা উচিত। রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম মিশবে না। তিনি আরও বলেছেন, হিন্দু, মুসলিম, শিখদের মধ্যে ভোট ভাগাভাগি মানব না, তাতে একা থাকতে হলেও থাকব।
তিনি নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ করে বলেছেন, বিজেপি নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করেছে। সংবাদ মাধ্যমও বিজেপির হয়ে কাজ করেছে। মমতার কথায়, নির্বাচন কমিশনই এই নির্বাচনের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’। ‘ওপেন গেম’ খেলেছে ওরা। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে বিজেপি জিতেছে বলে দাবি করেছেন মমতা।
এদিন দলীয় পর্যালোচনা বৈঠকে বিজেপির কাছে তৃণমূল কংগ্রেসকে কেন এত বেশি আসন খোয়াতে হলো, কোথায় কী ত্রুটি হয়েছিল এবং এই ক্ষয় মেরামত হবে কীভাবে, সব নিয়েই এই আলোচনা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। দলীয় সংগঠনেরও এদিন তিনি বেশ কিছু রদবদল করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, আমি এখনও বিশ্বাস করি, ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইতে নেতৃত্ব দেবে বাংলা। মানুষ ওদের বিশ্বাস করবে না। আমি ভবিষ্যৎবাণী করছি না। কিন্তু মানুষের আসলটা বুঝতে একটু সময় লাগবে। উল্লেখ্য, এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মতো তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্গে বিজেপির বিপুল উত্থান হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের হার বাড়লেও আসন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এবার তারা পেয়েছে মাত্র ২২টি আসন। সেখানে ভোটের হারে যেমন তেমনি আসন সংখ্যাতেও বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের কাছাকাছি চলে এসেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিধানসভার ১২৯টিতেই তৃণমূল বিজেপির কাছে পিছিয়ে পড়েছে।
অন্য দিকে, লোকসভার নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকেই রাহুলের ইস্তফা নিয়ে জল্পনা ছিল তুঙ্গে। এদিনের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, মনমোহন সিংহসহ দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পর সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা বলেছেন, রাহুল গান্ধী দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সর্বসম্মতিভাবে সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে ওয়ার্কি কমিটি। তিনি জানিয়েছেন, কমিটির সবাই সহমত প্রকাশ করে বলেছেন, চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে রাহুলের নেতৃত্ব দরকার। যুবক, কৃষক, মহিলা ও পিছিয়ে পড়া, সংখ্যালঘু, শোষিতদের সমস্যার সমাধানে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। কংগ্রেস সভাপতি সংগঠনের আমূল পরিবর্তন ও বিস্তৃত করুন। এদিনে সাংবাদিক বৈঠকেও কংগ্রেস নেতারা রাহুলের পক্ষ নিয়ে একের পর এক ওকালতি করে গেছেন। গুলাম নবি আজাদ বলেছেন, হারজিত থাকে। কিন্তু সামনে থেকে লড়াই করেছেন রাহুল। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। মানুষের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
হারের দায় স্বীকার করে ইস্তফা দিতে চান তিনি। কিন্তু এই প্রথম দেখলাম, সর্বসম্মতভাবে নেতারা আপত্তি করলেন। রাহুলকে বলেছি, আপনার নেতৃত্বে সবাই কাজ করবেন। আমরা অনুরোধ করছি, নিজের মতো করে আপনি বদল করতে পারেন। আরেক বলিষ্ঠ নেতা একে অ্যান্টনি বলেছেন, কংগ্রেসের বিপর্যয় হয়েছে- এমনটা নয়। প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করবে দল। কমিটিতে শুধু সাধারণ নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের তুলনায় কংগ্রেস ৮টি আসন বাড়াতে পারলেও কংগ্রেসের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে নানা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায়।
রাহুলের ‘চৈকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানও ফ্লপ করেছে। কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলসহ ১৭টি রাজ্যে পুরোপুরি ধরাশায়ী হয়েছে কংগ্রেস। যে ছত্তিসগড়, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে বিধানসভার জয় কংগ্রেসকে লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করার বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছিল, সেই তিন রাজ্যেই মোদি ঝড়ে উড়ে গেছে রাহুলের ক্যারিশমা। ছত্তিসগড়ে ২টি, মধ্যপ্রদেশে ১টি এবং রাজস্থানে তো কোনো আসনই পায়নি কংগ্রেস। উল্লেখযোগ্য ফল বলতে তামিলনাডু ও পাঞ্জাব, যেখানে কংগ্রেস আটটি করে আসন পেয়েছে। তবে ফল প্রকাশের পরই নাকি রাহুল ইস্তফা দেয়ার কথা ভেবেছিলেন। মা সোনিয়াসহ দলের নেতারা তাঁকে বুঝিয়েছেন। আর শনিবার গোটা দল তার পেছনে দাঁড়িয়েছে।
সরকার গঠনের দাবি জানালেন মোদিঃ
ভারতে নতুন সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক দাবি জানিয়েছেন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের (এনডিএ) নেতা নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। গতকাল রাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্র্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে দেশের বৃহত্তম জোটের নেতা হিসেবে সরকার গঠন করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। তবে কবে নাগাদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি শপথ নেবেন তা এখনো ঘোষণা করা হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২৮ কিংবা ৩০শে মে সরকার গঠন হতে পারে। এদিন সন্ধ্যাতেই সংসদের সেন্ট্রাল হলে বিজেপিসহ এনডিএ-র সব শরিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এনডিএ-এর সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করেছেন নরেন্দ্র মোদিকে। বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি আমিত শাহ নরেন্দ্র মোদির নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তারপরেই সকলে মোদিকে সমর্থন করেছেন। এবারের নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট রেকর্ড ৩৫৪টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। জানা গেছে, মোদি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার আগে এনডিএ-র শরিক দলের নেতারা আলাদাভাবে রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে মোদির প্রতি তাদের সমর্থনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। এদিকে এদিন বিকালেই নির্বাচন কমিশনের তিন কমিশনার রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দিয়েছেন লোকসভার ৫৪২টি আসনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা। সেইসঙ্গে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা অনুযায়ী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নামের যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে তারও অনুলিপি তুলে দিয়েছেন।
এদিকে, সপ্তদশ লোকসভা এবং নতুন সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করতে ভারতের ষোড়শ লোকসভা ইতিমধ্যেই ভেঙে দেয়া হয়েছে। গতকাল রাষ্ট্রপতি ভবনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সুপারিশ অনুযায়ী ষোড়শ লোকসভা ভেঙে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শুক্রবার ভারতের মন্ত্রিসভা লোকসভা ভেঙে দেবার যে সুপারিশ পাঠিয়েছেন তাকে রাষ্ট্রপতি গ্রহণ করেছেন। সেইসঙ্গে আরো জানানো হয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগপত্রও গ্রহণ করেছেন। তবে তাদের সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। অন্যদিকে জানা গেছে, প্রোটেম স্পিকার নির্বাচিত হতে চলেছেন বেরিলি থেকে নির্বাচিত প্রবীণ সংসদ সদস্য সন্তোষ কুমার গাঙ্গোয়ার। তিনিই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করাবেন।