ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দানকারী ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে ভারত সরকার। গত কয়েকদিন ধরে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে উত্তেজনার পারদ যেভাবে চড়ছিল তা থেকে অনুমান করা গিয়েছিল বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে মোদি সরকার।
দু’দিন ধরে বেশ কয়েক দফা উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের শেষে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়। এর পরই সংসদে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেন- জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে নিয়েছে ভারত সরকার। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তি তিনি পড়ে শোনান। এ ঘোষণার ফলে জম্মু-কাশ্মীর প্রায় ৭০ বছর ধরে যে বিশেষ স্ব-শাসিত মর্যাদা পেয়ে আসছিল তার অবসান ঘটতে চলেছে।
একইসঙ্গে নতুন ঘোষণায় ভেঙে আলাদা করে দেয়া হয়েছে লাদাখকে। এখন থেকে আলাদা দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হচ্ছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ।
দু’টি জায়গাতেই দু’জন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হবে। তবে জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভা বহাল থাকবে। লাদাখের ক্ষেত্রে কোনো বিধানসভা থাকবে না। কার্যত এদিন থেকে নতুন করে কাশ্মীরের ইতিহাস লেখা শুরু করেছে মোদি সরকার।
কি এই ৩৭০ ধারা?
এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ স্ব-শাসিত মর্যাদা দেয়ার উল্লেখ ছিল। ধারা অনুযায়ী- প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগসহ কিছু বিষয় ছাড়া যেকোনো আইন জম্মু-কাশ্মীরে প্রয়োগ করতে সংসদকে জম্মু-কাশ্মীর সরকারের সম্মতি নিতে হতো। নাগরিকত্ব, সম্পত্তির মালিকানা ও নাগরিক অধিকার সম্পর্কীয় বিষয়ে রাজ্যের বাসিন্দারা পৃথক আইনের আওতায় ছিলেন। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দারা সেই আইনের আওতায় ছিলেন না। এই ধারা অনুযায়ী, জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধান পুরোপুরি মানতে হতো না। জম্মু-কাশ্মীরের নিজস্ব পৃথক সংবিধান ছিল। আইনের এই ধারায় বলা ছিল, কাশ্মীরের মানুষই কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবেন। ভারতের অন্য রাজ্যের মানুষ জম্মু-কাশ্মীরে কোনো সম্পত্তি কিনতে পারবে না। কেন্দ্রীয় সরকার কোনো রকম আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবে না। একমাত্র যুদ্ধ হলে ও শত্রুরাষ্ট্র আগ্রাসী পদক্ষেপ নিলেই কেন্দ্র জরুরি অবস্থা জারি করার অধিকারী ছিল।
৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে জম্মু-কাশ্মীরের আলাদা কোনো পতাকা থাকবে না। সেখানে এখন থেকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে। সোমবার থেকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল হয়ে গেল। ফলে দেশের ভেতরে অন্য অংশে যেসব আইন প্রয়োগ হয় তা প্রযোজ্য হবে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখে।
অন্য রাজ্য থেকে যাওয়া ভারতীয় নাগরিকরা ওই অঞ্চলে সরকারি চাকরি পেতে পারবেন। জম্মু, কাশ্মীর বা লাদাখের বাইরে কারো সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে একজন নারীর অধিকার প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয়ক, অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ বিষয়ক যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকার।
অনির্দিষ্ট কারফিউয়ের খবরে কাশ্মীরে আতঙ্কঃ
থমথমে জম্মু-কাশ্মীর। সোমবার থেকে সেখানে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি হতে পারে এমন রিপোর্টে চারদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। জরুরি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের জন্য দু’চারজনকে দেখা গেছে বাইরে। উপত্যকার স্পর্শকাতর এলাকা ও শ্রীনগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন সিভিল সেক্রেটারিয়েট, পুলিশ সদর দপ্তর, বিমান বন্দর ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য। রোববার সারাদিন শ্রীনগরের জওয়াহার নগর, রাজবাগ, লাল চক ও করণ নগর এলাকায় বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ ছিল। কয়েকদিন পরেই ঈদুল আজহা হলেও মানুষের মধ্যে আনন্দ নেই। তাদেরকে ঘরে বন্দি অবস্থায় কাটাতে হচ্ছে। পেট্রোল পাম্পগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। বেশিরভাগ পেট্রোল পাম্পে এরই মধ্যে জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। সামনে কি ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে তা নিয়ে সবার মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক। অনেক স্থানে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে মোবাইল, ইন্টারনেট ও ল্যান্ডফোনের সংযোগ। ফলে আতঙ্ক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
এরই মধ্যে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী কাশ্মীর উপত্যকায় উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। প্রচলিত টেলিকম নেটওয়ার্ককে পাশ কাটিয়ে যোগাযোগের জন্য পুলিশ স্টেশনগুলোকে রোববার সরবরাহ করা হয়েছে স্যাটেলাইট ফোন। বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অমরনাথ যাত্রার সময় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিরা সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে বলে এমন সতর্কতা অবলম্বন করেছে ভারত সরকার। কিন্তু অন্য রিপোর্টে বলা হয়েছে, জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের বিশেষ মর্যাদার পরিবর্তন করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকার আগেভাগে সেখানে উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
কয়েকদিনে জম্মু-কাশ্মীরে আধাসামরিক বাহিনীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ানো হয়েছে। সেখানে মোতায়েন ৩৫ হাজার আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরো ২৫ হাজার জওয়ান। রাজ্যে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় এসব করা হচ্ছিল বলে প্রথমে মনে হয়েছিল। কিন্তু এরপর একের পর এক ঘোষণা করা হয়েছে নানা সিদ্ধান্ত। জম্মু-কাশ্মীর থেকে সব পর্যটকদের চলে যেতে বলা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অমরনাথ তীর্থ যাত্রাও। গত শনিবার থেকে সব স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গোটা রাজ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। মানুষের মধ্যে এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সাবেক ২ মুখ্যমন্ত্রী গৃহবন্দিঃ
কাশ্মীরে নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কতার মধ্যে গৃহবন্দি করা হয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আবদুল্লাহকে। রোববার আরো গৃহবন্দি করা হয়েছে সাজাদ লোন’কে। এ তিনজনই জম্মু ও কাশ্মীরে সবচেয়ে সুপরিচিত রাজনীতিক। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোববার দিনের শুরুতে মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাহ ও রাজ্যের সব রাজনৈতিক দলের নেতারা একটি বৈঠক করে প্রস্তাব গ্রহণ করেন। যদি জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের বিশেষ মর্যাদার পরিবর্তন করা হয় তাহলে এর বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে করুণ পরিণতির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছিল এতে।
গৃহবন্দি অবস্থা থেকেই টুইট করেছেন ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতি। তারা টুইটার ব্যবহার করে কাশ্মীরের মানুষকে শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদেরকে গৃহবন্দি করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রোববার দিবাগত রাতে ওমর আবদুল্লাহ টুইট করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, আমরা জানি না আমাদের ভাগ্যে কি আছে। আমার মনে হচ্ছে আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা। তিনি জনগণকে যেকোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, তারা যেন কোনো অবস্থায়ই সহিংসতায় লিপ্ত না হন। তিনি টুইটে আরো বলেছেন, যারা রাজ্যের উত্তম স্বার্থ চায় না তারাই সহিংসতার আশ্রয় নেয়। ভারত বা জম্মু-কাশ্মীর এমনটা চায় না। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। আল্লাহ আপনাদের সঙ্গে থাকবেন।
এমন অবস্থায় কারগিল, লাদাখ এবং জম্মুতে যারা বসবাস করছেন তাদের উদ্দেশ্যে ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, যদিও তিনি জানেন না রাজ্যের ভাগ্যে কি ঘটতে চলেছে, তবে তিনি আশঙ্কা করতে পারছেন, ভালো কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার ভাষায়, যখনই কাশ্মীর ইস্যুতে আমি দৃষ্টি দিই তখনই আমাকে আরো কিছু শব্দ যোগ করতে হয়। সেটা হলো কারগিল, লাদাখ ও জম্মু। যা ঘটছে তাতে আপনারা অনেকেই হতাশ হবেন এটা আমি জানি। তবু আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। শান্ত থাকুন।
অন্যদিকে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গৃহবন্দি রাখার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান মেহবুবা মুফতি। তিনি অভিযোগ করেন, রাজ্যের জনগণ ও তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি ভারতকে জেগে উঠার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কতটা নিষ্ঠুর বিষয় এটা যে, আমাদের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, যারা শান্তির জন্য লড়াই করে, তাদেরকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছে। কাশ্মীরের জনগণ ও তাদের কণ্ঠকে কিভাবে স্তব্ধ করে রাখা হচ্ছে তা বিশ্ব দেখছে। তিনি সব কাশ্মীরিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো কিছুই আমাদেরকে বিচ্যুত করতে পারবে না।
বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে কাশ্মীর নিয়ে এই প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছিল। ইস্তেহারে জানানো হয়েছিল, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সম্মানের সঙ্গে ফেরাতে ও নিরাপত্তা দেয়া বিজেপির অন্যতম এজেন্ডা। জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয়া নিয়ে অমিত শাহ বলেন, ৩৭০ ধারা কাশ্মীরকে দেশের সঙ্গে এক হতে দেয়নি। তবে বিরোধীদের একাংশ মোদি সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেছে সংসদের দুটি সভাতেই। কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেছেন, বিজেপি দেশের সংবিধানকে হত্যা করেছে। তবে অনেক বিরোধী নেতা কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল মোদি সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।