ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ দেশের অর্থনীতির ব্যপক উন্নতি হচ্ছে বলা হলেও সামগ্রিক অর্থনীতির সূচকগুলোর অবস্থা ভালো নয়। রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ দিচ্ছে সরকার।
খেলাপি ঋণ ও পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির মধ্যে নতুন সংকট তৈরি করছে নয়-ছয় ফর্মুলা। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে নানা উদ্যোগের কথা বলো হলেও সেগুলো সফলভাবে কার্যকর করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতির মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ অনেক কঠিন হবে। সম্প্রতি এক কর্মশালায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ড. আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন।
রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে সামষ্টিক অর্থনীতি ও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন শীর্ষক এ কর্মশালার যৌথ আয়োজক ইআরএফ ও পিআরআই। এতে অন্যদের মধ্যে পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার, গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত ১০ বছরে ব্যাংক ব্যবসায় লাভের পরিমাণ বহুগুণ কমেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ জনগণ। কিন্তু লাভবান হয়েছেন ব্যাংক মালিকরা। এক ব্যাংক মালিক অন্য ব্যাংক থেকে এবং ওই ব্যাংক মালিক অপর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু কাউকেই সেটা আর পরিশোধ করতে হয় না। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই ব্যাংক মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেকে। জনগণের উপকারের জন্য নয়।
ড. মনসুর বলেন, সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির যে তথ্য উঠে এসেছে আমার মনে হয় এর বাস্তব চিত্র দ্বিগুণ। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃত খেলাপি ২৩ শতাংশ; যা অঙ্কের বিবেচনায় ৪ লাখ কোটি টাকার ওপরে।
পিআরআইয়ের এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, সম্প্রতি ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা মোটেও যৌক্তিক নয়। এটি বাস্তবায়নের কিছুদিনের মধ্যেই অর্থনীতিতে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে। ক্ষুদ্রশিল্প খাত পরিত্যক্ত হয়ে পড়বে। কারণ এই ঋণের পরিচালন ব্যয় বেশি। তখন ইচ্ছা করেই ব্যাংকগুলো এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ করবে না। একদিকে খেলাপি, মূল্যস্ফীতি অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানির অবনমন অর্থনীতিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তিনি আরও জানান, এ বছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার যে ঋণ নেবে তার পরিমাণ গত ৪৮ বছরের সমগ্র ঋনের সমান। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে সরকার পরিশোধ করবে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশে ঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ব্যাংকগুলো সুযোগ পেলেই সরকারকে ঋণ দেবে, বেসরকারি খাতে নয়। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যেসব নীতিমালা নেওয়া হচ্ছে এর সবগুলোই ভারসাম্যহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ড. মনসুর বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় জিডিপিতে রাজস্বের অনুপাত অনেক কম। এত কম রাজস্ব দিয়ে মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন পূরণ হওয়া কঠিন। এখনো কোনো রাজস্ব অফিসে ট্যাক্স জমা দিতে গেলে ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। ট্যাক্স ব্যবস্থার আধুনিকায়নে অফিসাররা আগ্রহী নন। কিন্তু প্রতি বছরই ট্যাক্স কালেকশনের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কিন্তু আদায়ের চিত্র পুরোপুরি উল্টো। প্রতিটি জেলায় ডিজিটাল মেশিন স্থাপনের সর্বশেষ উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। কোনো নিয়মনীতি এখানে কাজ করছে না। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে স্বপ্নপূরণ সম্ভব নয়। তিনি বলেন, অর্থনীতির সুফল ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। সরকার
কৃষকদের ধান কেনার উদ্যোগ নিচ্ছে ঠিকই কিন্তু কৃষক ধান বিক্রি করতে পারছেন না। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারের কাছে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এভাবে সরকারের পদক্ষেপগুলোর সুবিধায় পকেট ভরছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের।
অনুষ্ঠানে পিআরআই গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে গেলে বাংলাদেশকে প্রধানত তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বাণিজ্যিক চাপ সৃষ্টি, নীতিমালা তৈরিতে সুযোগ সংকোচন এবং উন্নয়ন সাহায্য কমে আসতে পারে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত আয়ের দেশ হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানিতে জিরো ডিউটি বা শূন্য শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ।কিন্তু ২০২৪ সালের পর ন্যূনতম ২ দশমিক ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক গুনতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, যুক্তরাজ্য, চীন ও ভারতের মতো বড় বাজারে বাণিজ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। ক্ষতি এড়ানোর কৌশল বাংলাদেশকেই নির্ধারণ করতে হবে।