ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের আলেম হত্যার ঘটনার পর হাসিনা সরকারের খুব কাছাকাছি চলে আসা হেফাজতে ইসলাম সম্প্রতি রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের তীব্র বিরোধিতা করায় রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারি দল ও সমর্থক এবং হেফাজতে ইসলামের নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও বিষদগারে সম্পর্কের জায়গায়ও বেশ চিড় ধরেছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী হেফাজতের দাবির সাথে একমত পোষণ করতে হলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে আওয়ামী লীগকে সরে আসতে হবে।
আবার ভাস্কর্য নির্মাণ করতে গেলে হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের স্থায়ী দূরত্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব নানা বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে সরকারি দলকে। ফলে সমমনা ইসলামী দলগুলোর জোট হেফাজতে ইসলাম নিয়ে নতুন করে লাভক্ষতির হিসাব-নিকাশ কষছে আওয়ামী লীগ। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে।
হেফাজতে ইসলামসহ সমমনা ইসলামী দলগুলো বলছে, তারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধী নন, কিন্তু ভাস্কর্যবিরোধী। ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ হতে পারে না। এটি কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী। পরামর্শ উপেক্ষা করে সরকার ভাস্কর্য নির্মাণ করলে আলেম-ওলামাদের সাথে স্থায়ী দূরত্ব সৃষ্টি হবে।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর থেকে সরকারের সাথে একটি সুসস্পর্ক তৈরি হয় হেফাজতে ইসলামের। ওই সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরই কওমি মাদরাসাকে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ধারায় আনার জন্য ইসলামিক স্টাডিজ এবং আরবি এই দু’টি বিষয়কে মাস্টার্সের সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। তখনকার হেফাজতে ইসলামের আমির ছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী।
সম্প্রতি আহমদ শফীর ইন্তেকালের পর হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছে। তা ছাড়া হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের তরফ থেকে লিয়াজোঁ মেইনটেন করার জন্য ছিলেন আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ও ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো: আব্দুল্লাহ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি শামীম মোহাম্মদ আফজাল। তারা দু’জনই বৈশ্বিক মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু দিন আগে মারা গেছেন। এর পর থেকেই হেফাজতে ইসলামের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে।
সূত্র আরো বলছে, রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে চলমান পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হিসেবে জামালপুর-২ আসনের এমপি মো: ফরিদুল হক খানকে নিয়োগ দিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা। হেফাজতে ইসলামের সাথে কিভাবে দূরত্ব কমিয়ে আনা যায় সেই বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তারা কাজ করছেন। তবে আল্লামা আহমদ শফী মৃত্যুবরণ করায় হেফাজতে ইসলামের রাজনীতিতে শফীপন্থীরাও অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। যার ফলে তাদেরও সরকারের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকায় এক ধরনের গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। ওই গ্যাপ পূরণ করে সামনের দিকে কিভাবে এগোনো যায় সেই বিষয়টি নিয়েও কাজ করছে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের লোকজন। তা ছাড়া হেফাজতের নতুন কমিটির সাথে সরকারের বনিবনা না হলে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেই বিষয়টি নিয়েও চিন্তাভাবনা করছেন তারা। ইতোমধ্যে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতাদের চাপে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কঠোর পদক্ষেপের কথা বলেছেন। এ ছাড়াও রাজপথে প্রায় প্রতিদিনই মিছিল, সভা সমাবেশ ও মানববন্ধন করছে সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন।
হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের দূরত্ব প্রসঙ্গে আওয়ামী ওলামা লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফেয়ী নয়া দিগন্তকে বলেন, আহমদ শফী থাকাকালীন হেফাজতের সাথে সরকারের সুসম্পর্ক ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর থেকেই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। হেফাজতের নতুন যে কমিটি হয়েছে ওই কমিটির সাথেও সরকারের সম্পর্ক ভালো না। বর্তমান কমিটির মধ্যে ২০ দলীয় জোটের লোকজন ঢুকে পড়েছে। তা ছাড়াও শফীপন্থী আরেকটি গ্রুপ সরকারের সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় তারাও আর সরকারের কাছে আসছে না। তিনি বলেন, আমরা চাই, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হোক। তবে এই মুহূর্তে ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে আওয়ামী লীগ কঠোর অবস্থানে গেলে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হবে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী হিসেবে প্রমাণ করা সহজ হবে। সরকারের উচিত হবে, হেফাজতের সাথে সংলাপ করা। এ জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে। এতে সুফল পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ধর্ম উপকমিটির চেয়ারম্যান খন্দকার গোলাম মওলা নকশবন্দী বলেন, ইসলাম উদারতার ধর্ম। ইসলামে সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রতার কোনো স্থান নেই। তিনি বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভাস্কর্যকে মূর্তির সাথে তুলনা করে সমাজকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশেও অনেক আগে থেকে বহু নেতা, কবি, সাহিত্যিকের ভাস্কর্য আছে।
তখন কেউ কিছু বলেন নাই। হঠাৎ করে এই প্রশ্ন আনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মন্ত্রী বলেন, ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম, এর অপব্যাখ্যা করে বিভ্রান্তি না ছড়ানোর জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে হেফাজতে ইসলামের সাথে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে এটা ভুল বোঝাবুঝি মাত্র। আশা করি, কিছু দিনের মধ্যে এটার অবসান হবে। তিনি বলেন, ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য আছে, এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী স্কলাররাও বলছেন। ইসলামী ও মুসলিম অনেক দেশে ভাস্কর্য রয়েছে, এ বিষয়টাও দেখতে হবে।