ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের পঞ্চাশতম স্বাধীনতা বার্ষিকী শুরু হওয়ার স্মরণে এক সম্মেলনে শেখ হাসিনা, মোদীর সঙ্গে যোগ দেবেন। এর এক সপ্তাহ আগেই চীনা কোম্পানির প্রকৌশলীরা তাদের বাংলাদেশি সহযোগীদের সঙ্গে মিলে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যানটি স্থাপন করেছে।
ভারতের বহুল আলোচিত অনলাইন পত্রিকা দ্য প্রিন্ট এ লেখা এক নিবন্ধে দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক জ্যোতি মালহোত্রা এসব কথা লেখেন। সোমবার প্রকাশিত ইংরেজিতে লেখা জ্যোতি মালহোত্রার নিবন্ধটি হুবহু অনুবাদ করা হলোঃ
বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ এক দিন। গণমাধ্যম বর্ণনা করেছে ঐতিহাসিক সেই অনুষ্ঠানটি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইংরেজি সংবাদপত্র ডেইলি স্টার এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম, যিনি নিজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রায়ই হাসিনা সরকারের সমালোচনা করেন, তিনি সংক্ষেপে বলেছেন, "বঙ্গবন্ধুর 'রাজনৈতিক ইচ্ছা' বাংলাদেশের জন্মের ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছিল। একইভাবে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ইচ্ছাই পদ্মা সেতুটি বাস্তবে রূপ নেবার দাবিদার।"
পদ্মাসেতুর নির্মাণ নির্ধারণ করে যে, চীন কিভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় তার পথ করে নিয়েছ। এই অঞ্চলে ভারতের অত্যধিক প্রভাব প্রতিস্থাপন করতে। এটা স্পষ্ট করতে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো জায়গা আর কি হতে পারে যেখানে ভারত বেশ কয়েক বছরের শৈশব পার করার পর অবশেষে একটি পরিণত সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
কারণ স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করা প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক বিষয়ে ভারত অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং পদ্মাসেতু তৈরিতে সহায়তার জন্য এক বিলিয়ন ডলারের 'লাইন অফ ক্রেডিট' ঘোষণা করেছিলেন। যা বাংলাদেশের নিজস্ব ৩ বিলিয়ন ডলারের সঙ্গে যুক্ত হতো। যেটি আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা থেকে বাংলাদেশ ঋণ হিসেবে নিতো।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের জাইকার অন্য হিসেব ছিল। ২০১৩ সালে তারা দুর্নীতির অভিযোগ আনে। তাদের “অহঙ্কার” এবং “নির্দয় আচরণ” দেখে বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে হাসিনা ঋণের আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। মাহফুজ আনামের মতে, "আমাদের আত্মসম্মানে লাগা গভীর ক্ষতে" হাসিনাকে বলতে বাধ্য করে, "আমাদের ভিক্ষাবৃত্তির মানসিকতা দূরে রাখতে হবে।" এটি যদিও "আত্মনির্ভরশীল" ছিল না। হাসিনা সত্যিই টাকাওয়ালা বন্ধুদের খুঁজছিলেন।
২০১৫ সালের জুনে যখন নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় গিয়েছিলেন, তখনো ভারতের পাঠ চুকায়নি। দিল্লি ২০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান এবং পদ্মাসেতু প্রকল্পে ঝাঁপিয়ে পড়তে আরও ২ বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব দেয়। সেটা যথেষ্ট ছিল না। ইতোমধ্যেই টেন্ডার জিতে নেয়া চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কাজ শুরু করে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে শি জিনপিং ঢাকায় যান, যা ছিল ৩০ বছরের মধ্যে কোন চীনা প্রেসিডেন্টের প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণ। তিনি ২৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ঋণ সহায়তায় স্বাক্ষর করেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ৪২টি স্প্যানের প্রথমটি ৩৭ এবং ৩৮ তম পিলারের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছিল।
ব্যাপারটা এমন নয় যে, একটি সেতু সম্পর্ক তৈরি বা নষ্ট করে দিতে পারে। অন্যান্য সংযোগ প্রকল্প ছাড়াও (চিলাহাটি-হলদিবাড়ী) একটি পুরনো অচল রেললাইন পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব দিয়ে মোদী সরকার এখন এ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। শিলিগুড়ি থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত ২০১৮ সালে প্রতিশ্রুত একটি পেট্রোলিয়াম পাইপলাইনের নির্মাণ কাজ শেষ পর্যন্ত শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পঞ্চাশতম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের অংশ হিসাবে মোদি ঢাকা সফর করলে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে যা তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো ঢাকার মন-মানসিকতার পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ায় চূড়ান্ত বাস্তববাদী হিসেবে দেখিয়েছেন। খোলামেলাভাবে চীনাদের সঙ্গে 'মজা' করছেন। যদিও ১৯৭১'র যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল; প্রকৃতপক্ষে, চীন এমনকি ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য বাংলাদেশের আবেদনে ভেটো দিয়েছিল।
সুতরাং, একদিকে হাসিনা মোদির সঙ্গে ১৭ই ডিসেম্বর ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেবেন এবং অন্যদিকে তিনি শি জিনপিং এর বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্যও প্রস্তুত।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তিনি দিল্লিতে একটি বার্তা পাঠাতে চান যে 'বাংলাদেশিরা উইপোকা সমতুল্য, ওদের বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া উচিত' ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের এমন মন্তব্য তিনি ভুলে যাবেন না।
তদুপরি, জাতীয় নাগরিক নিবন্ধক (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) মুসলমান "বাংলাদেশিদের" ভারতীয় নাগরিক হওয়া থেকে বিরত রাখার প্রতিশ্রুতি দেয় – যা ঢাকার জন্য লাগাতার উদ্বেগের বিষয়। যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা বারবার বলছেন যে, এনআরসি এবং সিএএ দুটোই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
তদুপরি, ভারতের বিপরীতে চীনের অর্থনীতি করোনা ভাইরাস মহামারি দ্বারা খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক তথ্যমতে, বাংলাদেশ তার মাথাপিছু জিডিপি আয়ের ক্ষেত্রে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও পাঁচ বছর আগে ভারত ২৫ শতাংশ বেশি ছিল। যে কারণে বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান বলেছেন, "অভিযুক্ত উইপোকার কারখানাটি এখন জ্বলজ্বল করছে।"
তবুও সব শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ চীনকে সম্প্রতি ধমকের সুরে চলে যেতে অথবা চীনা করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য অর্থ প্রদান করতে বলেছে। এটি ঘটেছে এমন এক সময়ে যখন তিন কোটি ডোজ ভ্যাক্সিন কেনার জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ঢাকার একটি চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছিল।
গল্পটি থেকে শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, মোদি সরকার নিজ দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শিক এজেন্ডাকে জাতীয় স্বার্থের উপর স্থান দেয়ার অনুমতি দিতে পারে না। ভারতের বৈদেশিক নীতি, বিশেষত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর সংবেদনশীল প্রতিবেশী অঞ্চলে, দলীয় বিবেচনার বাইরে রাখা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোদিকে জোর দিয়ে বলতে হবে, ভারতে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যতিক্রমী উদাহরণ।