DMCA.com Protection Status
title="৭

আজ ঐতিহাসিক বদর দিবসঃ ইতিহাসে ইসলামের গৌরবজনক অধ্যায়

ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ  আজ ঐতিহাসিক বদর দিবস। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ ই রমজান ইতিহাস বিখ্যাত ‘বদর যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছিল। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এ দিবসটি অনন্য অবস্থান দখল করে রেখেছে।

দ্বিতীয় হিজরির কথা। রমজান মাসে কোরাইশদের একটি সুবিশাল বাণিজ্য কাফেলা বিপুল অর্থ-সম্পদ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র ক্রয় করে সিরিয়া থেকে ফিরছিল। তাদের দলপতি আবু সুফিয়ানের ভয় ছিল মুসলমানরা এগুলো তাদের থেকে ছিনিয়ে নেবে। তাই তারা  মক্কায় খবর পাঠাল যে তাদের সাহয্যের প্রয়োজন। 

মক্কার কোরাইশরা যেন তাদের দলবল নিয়ে অতি দ্রুত এখানে এসে পৌছে। তাদেরকে এই  মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করে। 

মক্কার কোরাইশরা সব সময়ই মুসলমানদের মূল উচ্ছেদ করার জন্য বিভিন্ন ফন্দি-ফিকির করে বেড়াত। তাই মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষায় রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল হিসেবে তাদের শক্তিমত্তা বিনষ্ট করার খুবই প্রয়োজন ছিল। 

কোরাইশদের সকল প্রকার শক্তির প্রধান উৎস ছিল সিরিয়ার বাণিজ্য; মুসলমানদের জন্য কোরাইশদের এই বাণিজ্যিক উন্নত ধারা বন্ধ করে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিল।

আবু সুফিয়ানের খবরটি মক্কায় পৌছলে কোরাইশরা এক হজার জনের বিশাল সেনাদল নিয়ে মুসলমানদের মোকাবেলায় বেরিয়ে পড়ল। আবু জেহেল সহ কোরাইশদের বড় বড় নেতারা ১০০ ঘোড়া আর ৭০০ উট নিয়ে এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। 

নবীজি (সা.) তাদের যুদ্ধবহর সম্পর্কে জানতে পারেন। তখন ১২ ই রমজান। নবীজি (সা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৩১৩ জন মুহাজির ও আনসার সাহাবি নিয়ে তাদের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। সাহাবায়ে কেরাম তাদের জীবন ও জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্পদ নবীজির নিকট সমর্পণ করে দিলেন।

অন্যদিকে কোরাইশদের নেতা আবু সুফিয়ান চলার পথে যাকেই পেত, মুসলমানদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত। বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই সে তার কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হয়। মুসলমানদের খবর নেয়। 

সে জানতে পারে, দুজন আরোহীকে টিলার পাশে তাদের উটকে বসিয়ে মশকে পানি ভরতে দেখা গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান তখন টিলার পাশে যায় এবং উটের গোবরে খেজুরের আঁটি খুজে পায়। তখন সে বুঝতে পারে এটা মদিনার উট, এর আসপাশে মুসলমানরা অবস্থান করছে। আবু সুফিয়ান মদিনার পথ এড়িয়ে সমুদ্রের উপকূল ধরে বণিকদের নিয়ে এগিয়ে চলল। 

ওই দিকে আবু জেহেল বদর অভিমুখে রওয়ানা দিয়ে দেয় এবং সে অহংকার করে বলে, আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। সমগ্র আরব জাতির ওপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে। সবাই আমাদেরকে ভয় পাবে। 

নবীজি (সা.) তাদের সম্পর্কে জানতে পেরে সাহাবিদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, তা নিয়ে তিনি উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন। 

হজরত আবু বকর ও ওমর (রা.) তাদের মূল্যবান পরামর্শ দান করলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনে আসওয়াদ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি। যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে মদিনার ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব।’

হজরত মিকদাদের এই জোরালো বক্তব্য নবীজি পছন্দ করলেন এবং তার জন্য কল্যাণের দোয়া করলেন। হজরত সাদ ইবনে মুআজ বললেন, ‘হে আল্লহর রাসুল! যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন।’ 

হজরত সাদের উক্ত কথা শুনে নবীজি (সা.) খুবই খুশি হলেন এবং বললেন, ‘চলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো।’

পরামর্শ সভা শেষে নবীজি (সা.) বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন। অতঃপর বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। ২য় হিজরির ১৭ ই রমজান ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ ই মার্চ শুক্রবার এখানেই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ। 

১৭ ই রমজান। শুক্রবার রাত। বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ বৃষ্টি এল। মুসলমান যোদ্ধারা ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্তুত হয়ে গেল। 

খুব ভোরে কোরাইশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে নেমে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের ওপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখলে চলে গেল। হাকেম ইবনে হেজাম কয়েকজন কোরাইশ বাহিনীকে নিয়ে পানির কুপের দিকে অগ্রসর হল। 

নবীজি বললেন, তাদেরকে যেন কিছু না করে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে তারা সেখান থেকে পানি পান করল এবং পরবর্তীতে যুদ্ধে নিহত হল। কিন্তু হাকেম সেই পানি পান করেনি। সে বেচে গেল। পরবর্তীতে ইসলাম কবুল করল।

অন্যদিকে কোরাইশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা টের পেল এবং আফসোস করতে লাগল। তবে তাদের ধারনা ছিল মুসলমানরা সংখ্যায় তিনশ বা তার কিছু কম হবে। আবু জেহেল কোরাইশদের নিয়ে মুসলমানদের দিকে এ গিয়ে এল। 

কিন্তু নবীজি (সা.) তার বাহিনীকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। কোরাইশদের পক্ষ থেকে ব্যাপক হারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তোমরা কেউ তীর ছুঁড়বে না। তোমাদের ওপরে তাদের তরবারি আসার আগে তোমরা কেউ তরবারি চালাবে না। এরপর কোরাইশদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল এবং মুসলমানরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেন। 
এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে মুসলানদের ঐতিহাসিক বিজয় রচিত হল। 

কোরাইশদের অনেক কাফের যোদ্ধারা মুসলমানদের হাতে বন্দি হল। এটা ছিল ইসলামের প্রথম সিদ্ধান্তমূলক মুসলমানদের পরিকল্পিত সামরিক জেহাদ।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে নবীজি (সা.) মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও দুনিয়াতে তোমার ইবাদত করার মতো কেউ না থাকুক, তাহলে এই ক্ষুদ্র দলটিকে নিশ্চিহ্ন হতে দাও। কিন্তু মহান আল্লাহ তা চাননি। 

তাই প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় মুসলমান যোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয় সুসজ্জিত বিশাল কোরাইশ বাহিনী। কোরাইশদের অহংকারের পতন হয়। যা ছিল মহান আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ। 
এই যুদ্ধে মুসলমানদের ১৪ জন সাহাবি যোদ্ধা শহিদ হন। 

কোরাইশদের ৭০ জন নিহত এবং ৭০ জন কাফের যোদ্ধা মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। যাদের অধিকাংশই নেতা পর্যায়ের লোক ছিল। 

বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হজরত ওমর, হজরত আলি ও হজরত আমির হামজা (রা.)। আর কোরাইশদের মধ্যে নেতত্ব দিয়েছিল আবু জাহেল, উৎবা, শায়বা ও পতাকাবাহী নজর ইবনে হারেশ, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা এবং আবু সুফিয়ান।

এ যুদ্ধে কোরাইশদের ২৪ জন সেনাপ্রধান নিহন হয়। কোরাইশদের প্রধান সেনাপতি আবু জেহলকে হত্যা করেন দুজন সহোদর আনসার কিশোর সাহাবি হজরত মাআজ ও মুআজ (রা.)।

নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধ শেষে বদর প্রান্তরে মুসলমানরা ৩ দিন পর্যন্ত অবস্থান করেন, চতুর্থ দিনে নবীজি (সা.) সবাইকে নিয়ে মদিনার পথে রওনা করেন। তাঁর সাথে ছিল বন্দি কোরায়েশরা এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। যুদ্ধবন্ধীদের সাথে আল্লাহর নবী ও মুসলিমরা যে সহমর্মিতা দেখান বিশ্বের ইতিহাসে তার নজির পাওয়া মুশকিল।

যুদ্ধসূচনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ: মদিনায় সফলভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মক্কার 
কোরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসায় লিপ্ত হল। আবদুল্লাহ ইবনে ওবাই ও ইহুদিরা যড়যন্ত্র শুরু করল। মুসলমানদের সঙ্গে সন্ধি শর্ত ভঙ্গ করল। 

কোরাইশরা তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা যুদ্ধের ঘোষাণা দিল। নবীজিকে চিরতরে নিশ্চিহৃ করার নিকৃষ্ট পরিকল্পনা ও নীল নকশা তারা আঁকল।

কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানদের অপপ্রচার, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য ঐশি বার্তা, মক্কাবাসীদের ক্ষোভ এবং কাফের দ্বারা মদিনা আক্রমণ ঠেকাতে মুসলমানরা মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ৮০ মাইল দূরে ১৭ ই রমজান কাফেরদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উপনীত হন।

এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ থেকে মুসলমানদের অর্জন ছিল- আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি, বিশ্ব জয়ের সূচনা, সর্বোত্তম ইতিহাস রচনা। প্রথম সামরিক বিজয়, কোরাইশদের চরম পরাজয়। মিথ্যার ওপর সত্যের জয়। 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!