ঢাকা মহানগর কমিটির চরম সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং প্রবল জনসমর্থনহীনতা, তাই আপাতত সিটি করপোরেশনের নির্বাচন চায় না সরকার। গত একযুগ ধরে নগর কমিটির নবায়ন না হওয়ায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি নয় দেশের ঐতিহ্যবাহী দলটি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য ওঠে এসেছে।
জানা গেছে, সম্মেলনের মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করার কথা থাকলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা খুবই নাজুক। হবে হবে করে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে হচ্ছে না এই নগর কমিটি। এতে রাজধানীতে অনেকটাই দুর্বল ক্ষমতাসীনরা। এমন অবস্থায় সিটি নির্বাচন দিলে নিশ্চিত ভরাডুবি হবে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এমনিতেই নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর ছাড়া বাকি সিটি করপোরেশনগুলোই নিজেদের হাতছাড়া।
যদিও গত ১২ ফেব্রুয়ারি গণভবনে দলের এক কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে দুইভাগে ভাগ করে কমিটি দিয়ে খুব দ্রুত সময়েই ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণের নির্বাচন শেষ করা হবে।
শুধু সভানেত্রীই নন ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব থানা, ওয়ার্ডে কাউন্সিল করে ঢাকা মহানগরের দুই অংশে কমিটি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শীর্ষ নেতারাও। কিন্তু গত দুই মাসে কমিটি করা তো দূরে থাক সব থানা, ওয়ার্ডের কাউন্সিলই সম্পন্ন করতে পারেনি ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ।
ঢাকা মহানগরের দুই অংশে আওয়ামী লীগের মোট ১৬৯টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি থানা, ১০৩টি ওয়ার্ড ও ১৭টি ইউনিয়ন। যার মধ্যে এখনো বাকি রয়েছে ৭ থানার সম্মেলন। আর মহানগরের সম্মেলন কবে হবে তা কেউ জানেন না।
এদিকে ঢাকা সিটির সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন নগর আওয়ামী লীগে ফিরে আসায় কমিটি গঠন নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন মেরুকরণ। কারণ সাঈদকে নিয়ে ইতিমধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত নগর আওয়ামী লীগ।
গত ১৬ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মুজিবনগর দিবস উদযাপন উপলক্ষে এক বর্ধিত সভার আয়োজন করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। এতে বক্তব্য রাখেন সাঈদ খোকন। এসময় তাকে মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে তাকে সাংগঠনিক সম্পাদক উল্লেখ করায় সভা শেষে অনেক নেতাকর্মী মহানগর নেতাদের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসময় সাঈদ খোকনের পক্ষ নেয়ায় এক ইউনিয়ন নেতা এবং থানা নেতাকে ধর ধর বলে তাড়াও দেয়া হয়। ফলে কার্যালয়ের ভেতরে সৃষ্টি হয় উত্তেজনা।
সাঈদ খোকনকে সাংগঠনিক সম্পাদক ঘোষণা দেয়ায় ক্ষোভ ঝেরেছেন নগরের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক শাহে আলম মুরাদও। খোকনের আবির্ভাবকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না এ নেতা। শাহে আলম মুরাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সাঈদ খোকন মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নেই। কারণ তিনি প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) মহানগর সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নিজেই প্রেসকনফারেন্স করে ওই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এমনকি তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও অনেক কটুক্তি করেছেন। তাই দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিনি কোনো পদে নেই। মহানগর আওয়ামী লীগ থেকেও তাকে এখনো কোনো পদ দেয়া হয়নি।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু সাঈদ খোকন আর শাহে আলম মুরাদই নন, দলের অনেকের মাঝেই এমন বিভক্তি রয়েছে। দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ার কারণে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের এমন কোন্দল ও অন্তর্দ্বন্দ্ব। অনেকের মধ্যে দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একে অপরের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার সাংগঠনিক কাজ বাদ দিয়ে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত। তাই মহানগর আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী না করে কোনোভাবেই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেবে না ক্ষমতাসীনরা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাপর উল্লাহ বলেন, ‘আমরা এখন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কোনো কিছু ভাবছিনা। এখন নগর আওয়ামী লীগের থানা, ওয়ার্ডের সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত আছি। তারপর ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবো।’
ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘আমাদের নগর আওয়ামী লীগের কয়েকটি থানা, ওয়ার্ডের কাউন্সিল বাকি আছে। এইগুলো শেষ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে নগর কমিটি ঘোষণা করা হবে। পরে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবো।’
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার জন্য একটি বিল তোলা হয়। এরপর ২৯ নভেম্বর সংসদে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) সংশোধনী আইন, ২০১১ নামে তা পাস হয়।
ঢাকার ৯২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৬টি নিয়ে দক্ষিণ এবং ৩৬টি ওয়ার্ড নিয়ে উত্তর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। বিলটি পাস হওয়ার পর থেকে দুই সিটি করপোরেশন চলছে দুই প্রশাসকের অধীনে।
এর আগে ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল সাদেক হোসেন খোকা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেব নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে আর কোনো নির্বাচন না হওয়ায় তিনি ২০১১ সাল পর্যন্ত ঢাকার মেয়র ছিলেন।