ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ শেষ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তৈমুর আলম খন্দকার ও এটিএম কামালকে হঠাৎ বাদ দেওয়ার খবরে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তে নড়চড়ে বসেছেন বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৈমুর আলম খন্দকার। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬৬ হাজারের বেশি ভোটে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে পরাজিত হন। এতে বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় তৈমুরকে এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, জেলার আহ্বায়ক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এবার তাকে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকেও বাদ দেওয়া হলো।
এ প্রসঙ্গে তৈমুর আলম খন্দকার যুগান্তরকে বলেন, বহিষ্কারের চিঠি এখনও পাইনি। বহিষ্কার করে থাকলে আলহামদুলিল্লাহ।
তৈমুরের সঙ্গে বহিষ্কার হওয়া এটিএম কামাল নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন। তিনি ছিলেন তৈমুরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। তাকেও প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার স্থলে মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আব্দুস সবুর খান সেন্টুকে।
সোমবার দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বহিষ্কারের চিঠি মঙ্গলবার তাদের দুজনের কাছে পৌঁছানো হয়।
জানা গেছে, দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কাউকে ছাড় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকমান্ড। এর অংশ হিসেবে এ দুই নেতাকে প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করেছে হাইকমান্ড।
এদিকে তৈমুরকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ বিএনপিকে এক ধরনের অস্বস্তি বিরাজ করছিল। দলের একটি বড় অংশ তার বিরোধিতা করছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে দল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর শুরুতেই ভোটের মাঠে ধাক্কা খান তৈমুর।
শুধু অব্যাহতি নয়, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ স্থানীয় নেতাকর্মীদের তৈমুরের পক্ষে মাঠে না নামার নির্দেশ দেন। নামলে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলেও জানানো হয়। কেন্দ্রের এমন কঠোর সিদ্ধান্তের কারণে স্থানীয় পদধারী অনেক নেতা শুরু থেকেই তৈমুরকে এড়িয়ে চলেন। তারা তৈমুরের দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যের বিষয়টি হাইকমান্ডের ফোকাসে আনেন বারবার। তৈমুর নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার পর তারা এতে দলের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হন।
এছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে তৈমুরবিরোধী বড় একটি অংশ দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। সিদ্ধিরগঞ্জে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিন এবং বন্দরের নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, গত নির্বাচনে ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনসহ জেলার অনেক নেতাই তৈমুরের সঙ্গে ছিলেন না।
বরং তারা তৈমুরের বিপক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে, যা ভোটের ফল বিশ্লেষণেও দেখা যায়। গিয়াসউদ্দিন ও আবুল কালামের ছেলে কাউন্সিলর পদে জয়লাভ করলেও ওই দুটি ওয়ার্ডে তৈমুর আলম নৌকার চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপি নেতারা তৈমুরকে মেনে নিতে পারছিলেন না।
এ ছাড়া তৈমুর আলম খন্দকারের নির্বাচনি প্রচারের কৌশলে ভুল ছিল। বিএনপির বহু নেতাকর্মী তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে তৈমুর নির্বাচনি প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর কৃপা চেয়েছেন বারবার। তিনি ব্যক্তিগত প্রচার ও স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন বারবার। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার চিকিৎসার দাবিটি তার প্রচারে গুরুত্বই পায়নি। এ নিয়ে দলের হাইকমান্ড ও তৃণমূল বিএনপির একটি অংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এসব কারণে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তৈমুরকে বহিষ্কারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ও এটিএম কামালকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দলে থেকে সিদ্ধান্ত অমান্য করলে তা শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড বলে গণ্য হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কেউ নির্বাচন করলে তাকে বহিষ্কার করা হবে।
তৈমুরের সঙ্গে বহিষ্কার হওয়া কামাল মহানগর বিএনপির পদে থেকেই তার পক্ষে কাজ করেন। এটি ভালোভাবে নেয়নি হাইকমান্ড। তৈমুরের প্রতি আনুগত্যই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বহিষ্কার প্রসঙ্গে মঙ্গলবার রাতে এটিএম কামাল যুগান্তরকে বলেন, বহিষ্কারের কথা শুনেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো চিঠি পাইনি। তবে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমি শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছি— এ কারণে হাইকমান্ড চাইলে আমাকে বহিষ্কার করতে পারেন। তবে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের একজন কর্মী হিসেবে আমি রাজনীতি করতে চাই।
রোববার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার হাতি প্রতীকে পান ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। অর্থাৎ ৬৬ হাজার ৫৩৫ ভোট বেশি পেয়ে তৈমুর আলম খন্দকারকে পরাজিত করেন আইভী।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এর পর আর জাতীয় সংসদের কোনো উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে তারা অংশ নেয়নি। গত বছর মার্চে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।
একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, দলীয় প্রতীকে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না-এমন সিদ্ধান্ত থাকলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পদধারী অনেকে স্বতন্ত্রভাবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ইউপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলের যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাদের বাধা দেওয়া হয়নি। বরং সে ক্ষেত্রে কাউকে দল থেকে শোকজ বা বহিষ্কার করা হবে না— এমন নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। যে কারণে গত বছর মার্চের পর থেকে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছেন, কেউ কেউ জয়ীও হয়েছেন। কিন্তু এখন পদে থেকে আর কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না— এটি দলীয় সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করে বড় ব্যবধানে হেরে গিয়ে তৈমুর দলের ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কারণ সবার ধারণা, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তৈমুর দলটির ছায়া প্রার্থী হিসেবেই লড়ছেন। তিনি হেরে গিয়ে বিএনপির জনমতকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন বলে কেন্দ্রের মূল্যায়ন।
নীতিনির্ধারকরা আরও জানান, দেশের নির্বাচনব্যবস্থা একেবারে ধ্বংসের পথে, যা নিয়ে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট নাগরিকসহ অনেকে। এমনকি বহির্বিশ্বও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগে র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব) ও সংস্থাটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সব মিলিয়ে সরকার চাপে রয়েছে। তাই এখন কিছুটা সুষ্ঠু নির্বাচন করে তারা দেশে-বিদেশে বার্তা দিতে চায় যে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। তবে বিএনপি সে ফাঁদে পা দেবে না। জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেষ্টা করবে সরকার। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে আর কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। পদে থেকে যারা অংশ নেবে, তাদের বহিষ্কার করা হবে। এর অংশ হিসেবেই তৈমুর ও কামালকে বহিষ্কার।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা তৈমুর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার পর যদি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা না হয় তবে ভবিষ্যতে অন্যরাও শৃঙ্খলাভঙ্গের পথে এগোনোর সাহস দেখাবে। তাই সবাইকে সতর্ক করতে দল তৈমুর ও কামালের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিল।