ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্পাদকদের উদ্দেশ্যে লেখা এক খোলা চিঠিতে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মানতায়েত্সকি দাবি করেছেন, ঢাকার কয়েকটি সংবাদমাধ্যম পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতো রাশিয়াবিরোধী পক্ষপাতদুষ্ট খবর প্রচার করছে।
ঢাকার একটি পিআর এজেন্সি রোববার রাষ্ট্রদূতের চিঠিটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠায়৷ পরবর্তীতে সোমবার সেটি দূতাবাসের ভেরিফাইড ফেসবুক পাতাতেও প্রকাশিত হয়৷ ইতোমধ্যে গনমাধ্যমকে চিঠিটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে রাশিয়া দূতাবাস৷
রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মানতায়েত্সকির স্বাক্ষর করা চার পাতার চিঠিতে মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে৷ তবে রাষ্ট্রদূত সেখানে এই দাবিও করেছেন যে, মস্কো এবং ঢাকার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির লক্ষ্য পূরণের উদ্দেশ্যে কিছু গণমাধ্যম বর্তমানে এই অবস্থান নিয়েছে৷
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘‘ইউক্রেনের পরিস্থিতি এবং সেখানে রাশিয়ার পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমের এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণকে আমি সেই সব শক্তির ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার অংশ মনে করছি, যারা রাশিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যকার উভয়ের জন্য লাভজনক সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ককে সবসময় অবমূল্যায়নের চেষ্টা করেছে৷ পঞ্চাশ বছর আগে দুদেশের মধ্যে এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল৷''
রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের সমালোচনা
ঢাকার বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম চিঠিটি প্রকাশ করেছে, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ‘পক্ষপাতদুষ্ট' – এমন দাবি করে রাষ্ট্রদূত কার্যত সাংবাদিকদের সততা এবং পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা আপত্তিকর৷
‘‘রাষ্ট্রদূত যদি সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলতেন এবং সেই সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ করতেন, তাহলে তা অনেক পেশাদার ব্যাপার হতো,'' বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রীয়াজ৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে নেয়া তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন সমালোচনামূলক বিশ্লেষণও প্রকাশ করছে৷ যদিও সবজায়গাতেই গণমাধ্যমের মধ্যে সাধারণত এক ধরনের অ্যাজেন্ডা সেটিংয়ের চেষ্টা দেখা যায়, তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ক্ষেত্রে মস্কোর অবস্থানের ব্যাখ্যাও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে প্রকাশ করেছে৷''
ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার-এর বাংলা সংস্করনের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা মনে করেন, একটি দেশের গণমাধ্যম কী প্রকাশ করবে বা কোন সূত্র থেকে তথ্য নেবে তা একজন রাষ্ট্রদূতের ঠিক করে দেয়া উচিত নয়৷
তিনি বলেন, ‘‘'রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য দেখে মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম কী করবে, কোন সূত্র ব্যবহার করবে, সেই বিষয়ে তিনি একটি নির্দেশনা দিচ্ছেন৷ আমি এই ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি না৷''
তবে গোলাম মোর্তোজা জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম, বিশেষ করে যাদের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তারা সঠিকভাবে পরিস্থিতি তুলে ধরতে পেরেছে বলে তিনি মনে করেন না৷
তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়ার যে শক্তি এবং ইউক্রেনের যে শক্তি, রাশিয়ার যে আক্রমণ আর ইউক্রেনে যে প্রতিরোধ, তা এক ধরনের অসম যুদ্ধ৷ রাশিয়া এক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে৷''
‘‘কিন্তু কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, রাশিয়ার অবস্থা বিপর্যস্ত, রাশিয়া সেখানে কিছু করতে পারছে না, ট্যাংকের মধ্যে হাজার হাজার সেনা মারা যাবে, কিংবা ইউক্রেন জিতে যাবে৷ এ ধরনের সংবাদ অনেক বড় করে উপস্থাপন করা হচ্ছে৷ ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না,'' যোগ করেন তিনি৷
-
ইউক্রেন রাশিয়ার স্বাভাবিক সম্পর্কের অতীত
ইয়ানুকোভিচের সময়
চার মাসের রাজনৈতিক সংকটের অবসান ঘটিয়ে ২০০৬ সালে ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী হন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ৷ পরে ২০১০ সালে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট৷ তার সঙ্গে ছিলে পুটিন সরকারের নিবিড় সম্পর্ক৷ ছবিতে ২০১০ সালে রাশিয়ার তখনকার প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের সঙ্গে বন্দর সংক্রান্ত একটি চুক্তি সাক্ষর অনুষ্ঠানে দেখা যাচ্ছে তাকে৷ ২০১৪ সালে বিক্ষোভের মুখে ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতা ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন৷
বাংলাদেশের সঙ্গে ইউক্রেনের তুলনাঃ
রুশ রাষ্ট্রদূত মানতায়েত্সকি তার চিঠিতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তার সঙ্গে বর্তমানে ইউক্রেনে রাশিয়ার পদক্ষেপের তুলনা করেছেন৷ তিনি দাবি করেছেন যে, পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসে রুশ ভাষাভাষী মানুষদের সহায়তা করতে সেখানে অভিযান চালাচ্ছে মস্কো৷
রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, ‘‘১৯৭১ সালে অবাঙালি প্রভুরা আধিপত্য বিস্তার করতে বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে যে হয়রানি, বৈষম্য ও সহিংসতা চালিয়েছিল, তা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সমর্থনে বন্ধ করতে বাংলাদেশিদের আট মাস সময় লেগেছিল৷ ফলে তারা স্বাধীনতা পায়, স্থানীয় ভাষায় কথা বলার অধিকার পায়।’’
‘‘পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাসের রুশভাষী লোকেরা গত আট বছর ধরে একই অধিকার পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে, যখন কিনা তারা কিয়েভের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা গণহত্যার শিকার হচ্ছে। একই কারণে, তাদের মাতৃভাষা বলার অধিকার নিশ্চিত করতে এবং ভাষাভিত্তিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে রাশিয়া আবারও এগিয়ে এসেছে,‘‘ দাবি করেন রাষ্ট্রদূত৷
তবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা মানানসই হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে রাষ্ট্রদূতের ধারণা তীর্যক এবং ভ্রমপূর্ণ৷ এক্ষেত্রে তিনি তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যা স্বাধীনতা ঘোষণাকে বৈধতা দেয় সেই বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন৷’’
‘‘সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকমাস ধরে চালিয়ে যাওয়া সাহসী লড়াইয়ের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন৷ ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্যদের নৈতিক এবং বস্তুগত সমর্থন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছে বটে, তবে দেশ স্বাধীনে মূল লড়াইটা এই দেশের মানুষই করেছেন,'' যোগ করেন তিনি৷
সম্পাদক গোলাম মোর্তোজাও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেনে রাশিয়া একটি আগ্রাসন শক্তি৷ রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়েছে ইউক্রেনে৷ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, ইউক্রেন ন্যাটোতে যেতে চেয়ে ঠিক করেনি, তবুও রাশিয়ার এই অধিকার নেই যে সে একটি স্বাধীন দেশে গিয়ে আক্রমণ করবে, বোমা মারবে, লাখ লাখ মানুষকে ঘরছাড়া করবে৷''
‘‘রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এখন ইউক্রেনে তাদের আগ্রাসনের তুলনা করেছেন, এটা নিছকই বাতুলতা৷ এর সামান্য কোনো ভিত্তি নেই এবং এটা খুবই হাস্যকর ব্যাপার৷''
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদ অনুযায়ী, ‘গণহত্যা’ হচ্ছে ‘‘কোনো একটি জাতি, জাতিগতগোষ্ঠী, ধর্মীয় গোষ্ঠী বা একটি জাতির সদস্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে নির্মূলের উদ্দেশ্যে সংগঠিত অপরাধ’’৷ ইউক্রেনে এ ধরনের লক্ষ্য নিয়ে বেসামরিক নাগরিক হত্যার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷