রানা প্লাজা ধসের এক বছর পার হলেও যে জমিটির ওপর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেই জমিটি কি করা হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। জমিটি এখন জেলা প্রশাসনের অধীনে রয়েছে।
সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশের ভিত্তিতে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার ব্যক্তিগত সকল সম্পত্তি ও রানা প্লাজা ভবনের পোশাক কারখানাগুলোর সকল মালামাল বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। এতে রানা প্লাজা ভবনের ১৮ শতাংশ জমিসহ রানার মোট এক একর ৭৫ শতাংশ জমি বাজেয়াপ্ত হচ্ছে।
সাভারের সহকারী কমিশনার (ভুমি) মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘গত বছরের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে সোহেল রানার ব্যক্তিগত সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও রানা প্লাজার পোশাক কারখানাগুলোর মালামাল জব্দের ব্যাপারে একটি রুল জারি করেন। পরে সরকারের পক্ষ থেকে ওই রুলের আদেশ বাস্তবায়ন করতে ঢাকা জেলা প্রশাসক, ঢাকার পুলিশ সুপার, সাভারের সহকারী কমিশনার-ভুমি ও জেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। গত ১৩ মার্চ এ সংক্রান্ত আদেশ পাওয়া যায়।’
এরপর গত ১৭ এপ্রিল ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে রানা প্লাজার জমি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে সরকারের দখলে নেয়ার বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিলে কেউ কোন আপত্তি জানায়নি।
এই জমি কি করা হবে জানাতে চাইলে সহকারী কমিশনার-ভুমি মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘জমির ব্যাপারে কোন নির্দেশনা নেই। পরবর্তী নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ব্যাপারে সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লা বলেন, ‘ধসে পড়া রানা প্লাজার যেসকল পোশাক কারখানা ছিল সেগুলোর সকল মালামাল ও মেশিনপত্র এবং ভবনটির ধ্বংসাবশেষ নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে সে অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেয়া হবে। তবে জমির ব্যাপারে আমার কাছে কোন নির্দেশনা নেই।’
এদিকে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে নিহত শ্রমিকদের স্মৃতিসরূপ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নিমার্ণের দাবি ওঠে ভবন ধসের পর থেকে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়, ওই জমিতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করার।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু (কেএম মিন্টু) বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমরা চাই ধসে পড়া রানা প্লাজার জমিতে সরকার বহুতল বিশিষ্ট একটি মার্কেট তৈরি করুক। মার্কেটের আয় দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসন করা হোক। মার্কেটের সামনে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভও থাকবে।’
সাভার পৌরসভার সূত্র জানায়, ধসে পড়া রানা প্লাজার ভবনটি চওডায় ছিল প্রায় ২৫০ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে ১০০০ ফুট। ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। এবং উদ্বোধন হয় ২০১০ সালে। ভবনটির এক অংশ নির্মাণ করা হয় ডোবার ওপর। দুর্ঘটনার সময় নয় তলায় নির্মানকাজ চলছিল।
১০০ তম দিনে শহীদ বেদী নির্মিত
‘যেখানেই শ্রমিক হত্য-গুম সেখানেই শহীদ বেদী’ শ্লোগানটির বাস্তব রূপ দিতে রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১০০ তম দিনে সাভারে শহীদ বেদী স্থাপন করে ‘শহীদ বেদী নির্মাণ কমিটি’।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্মরণে গত বছরের ২ আগস্ট ল্যাম্পপোস্ট, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন, ছাত্র গণমঞ্চ, প্রপদ (প্রগতির পথে পরিব্রাজক), গণমুক্তির গানের দল, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ ও দাবানল নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘শহীদ বেদী নির্মাণ কমিটি’ ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপের সামনে ‘প্রতিবাদে- প্রতিরোধে’ নামে প্রথম একটি স্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণ ও তাতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।
জানা গেছে, পাঁচ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট শহীদ বেদী ভাস্কর্যটির দেড় ফুট রয়েছে মাটির নীচে। সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাতের এক হাতে রয়েছে কাস্তে ও অন্য হাতে রয়েছে হাতুড়ি।
ভাস্কর্যটির বেজমেন্টও রাখা হয়েছে পাঁচ ফুট। দৃষ্টিনন্দন এ ভাস্কর্যটি করেছেন চারুকলার শিক্ষার্থী ভাস্কর অন্তু মোদক। আর সহকারী ভাস্কর হলেন রাকিব আনোয়ার।
শহীদ বেদী নির্মাণ কমিটির সমন্বয়ক আশিষ কোরাইয়া, ল্যামপোস্টের প্রিন্স আহমেদ, দাবানলের সুমন মৈত্র, গণ মুক্তির গানের দলের হাসান ফকরী, ছাত্র গণ মঞ্চের শান্তুনু সুমনসহ আরো কয়েকজন বাংলামেইলকে বলেন, ‘সাভার ট্র্যাজেডি কোনো দুর্ঘটনা নয়। এখানে জোর করে ডেকে এনে শ্রমিকদের হত্যা করা হয়। এ পরিকল্পিত অগনিত শ্রমিক হত্যা ও গুমের প্রতিবাদে এবং শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্যবদ্ধতার প্রতীক হিসেবে ধসে পড়া ভবনটির সামনে শহীদ বেদী নির্মাণ করা হয়।’
ধ্বংসস্থলটি এখন যেমন
ধসে পড়া রানা প্লাজা ভবনটির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি ডোবা ও সাভার মডেল থানার কাছে বংশী নদের তীরে ফেলা হয়। ধ্বংসাবশেষ অপসারণের পর জমিটি প্রথম কাটা তার দিয়ে ঘিরে দিয়ে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
এরপর টিন দিয়ে এলাকাটি ঘিরে দেয়া হয়। পথশিশুরা সংরক্ষিত এলাকায় পরিত্যাক্ত কাপড়, রড বা অন্যান্য মালামাল টেকাতে গিয়ে বেশ কয়েকদফা মানব দেহের বেশ কিছু মাথার খুলি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হাড় উদ্ধার করে। উদ্ধার হওয়া মানব দেহের ধ্বংসাবশেষের সাথে থাকা পোশাক ও আইডি কার্ড দেখে নিখোঁজ ছেলের মৃতদেহ সনাক্ত করেন এক বাবা।
এরপর থেকে নিখোঁজ শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন দাবি তোলে ধ্বংস্তুপের ভিতরে পুনরায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা জন্য। ধসে পড়া রানা প্লাজার স্থানটি প্রশাসন সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করলেও এখানে অহরহ লোকজন ঢুকে পড়ে।
ভবনটির সামনে শহীদ বেদীর আশে পাশে কয়েকটি অস্থায়ী দোকান-পাট গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া ধসে পড়া সামনের এলাকাটি ট্যাক্সি ও কাইন্টার বাসের স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো উচ্ছেদে প্রশাসনের কোন উদ্যোগ নেই।